Saturday, February 23, 2013

কালো যাদু - একখন্ডে সমাপ্ত সম্পূর্ণ পিশাচ কাহিনী




পিশাচ কাহিনী
কালো যাদু



‘সব কাজ সবার দ্বারা সম্ভব না।’, তীব্র আপত্তির সুরে বললেন আহসান সাহেব।
আহসান সাহেব তপুর বড় চাচা। রাজশাহী শহরের একজন শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। রাজশাহী কলেজের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি পড়াশুনা করেছেন কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে রীতিমত গবেষণা করেছেন আর সে বিষয়টা হল ব্লাক ম্যাজিক বা কালো যাদু। ব্লাক ম্যাজিকের উপর তিনি প্রচুর পড়াশুনা করেছেন, রাতের পর রাত কাটিয়েছেন শ্মশানঘাট আর কবরস্থানে। এমনকি হাতে কলমে ব্লাক ম্যাজিক শেখার জন্য তিনি বেশ কিছুদিন কাটিয়ে এসেছেন আফ্রিকায়, শিখেছেন সেখানকার ভয়ংকর সব কালো বিদ্যা, যার আফ্রিকান স্থানীয় নাম হল ভূডু।
তপু আহসান সাহেবের ছোট ভাইয়ের ছেলে। রাজশাহী কলেজের ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রচণ্ড ভালবাসেন তিনি তপুকে। তপুর প্রত্যেকটা আব্দার তিনি পূরণ করেন, কোন কিছুতেই না করেন না। কিন্তু যখন তপু বলল, সে ব্লাক ম্যাজিক শিখতে চায়, তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, তপুর পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
‘কেন সম্ভব না, তুমি পারলে আমি কেন পারব না?’, বলল তপু।
‘দেখ তপু, ব্লাক ম্যাজিক ছেলেখেলা না, পদে পদে এখানে বিপদের আশঙ্কা থাকে।’
‘থাকুক, তবুও আমি শিখব।’ একগুঁয়ের মত জবাব দিল তপু।
‘আমি তোকে শিখাবো না’ বড় চাচাও কম যাননা।
‘চাচা প্লিজ, আমি ঠিক পারব। দেখো কোন বিপদ হবে না।’
‘তপু, তোকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি, তোর দ্বারা এসব সম্ভব না। প্রচণ্ড সাহস লাগে এতে। সাহস না থাকলে ব্লাক ম্যাজিকের প্রথম স্তরটাই পার হওয়া যায় না।’
‘কিন্তু আমি পারব। সাহস আমিও কম রাখিনা।’ তীব্র জেদের সাথে উত্তর দিল তপু।
‘হ্যা, জানি তোর সাহস কতদূর। কদিন আগেও তো নিজের ছায়া দেখে ভয় পাতিস।’
‘সে তো বহুদিন আগের কথা, তখন তো আমি এক্কেবারে ছোট ছিলাম। ওসব কথা বাদ দাওতো, তুমি শিখাবে কিনা বলো।’
‘ না’ এক কথায় উত্তর দেন আহসান সাহেব।
‘চাচা প্লিজ, খালি একটা সুযোগ দাও। দেখো, আমি ঠিক পারব। যদি না পারি, তাহলে আর কখনও তোমাকে জ্বালাবো না। শুধু একটা সুযোগ দাও।’ অনুনয় ঝরে পরল তপুর কন্ঠ থেকে।

‘ কিন্তু .......’
‘প্লিজ চাচা, প্লিজ’
কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলেন আহসান সাহেব।
‘ঠিক আছে, কিন্তু মনে রাখিস একটাই মাত্র সুযোগ পাবি তুই। একটা ছোট পরীক্ষা হবে, যদি উত্তীর্ণ না হতে পারিস তাহলে আর কখনও ব্লাক ম্যাজিকের নাম মুখেও আনতে পারবিনা, ঠিক আছে?’ বললেন আহসান সাহেব।
‘রাজি,’ আনন্দে সব কটা দাঁত বের করে হাসল তপু।
‘আজ পঁচিশ তারিখ। পরশুদিন অর্থাৎ সাতাশ তারিখ অমাবস্যার রাত। পরশুদিন ঠিক রাত বারটার সময় একটা মাটির হাড়ি, এক সের আতপ চাল আর বিশটা দাঁতন নিয়ে কাদেরগঞ্জ কবরস্থানের ভিতরে ঢুকে যাবি। সোজা কিছুক্ষণ চলার পর অনেক পুরনো একটা বটগাছ দেখতে পাবি। বটগাছটার ডান পাশ দিয়ে একটা ছোট রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়ে একেবারে সোজা চলে যাবি। সেই রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় দেখবি অনেক পুরনো একটা ভাঙ্গা কবর আছে। কবরটার পাশে একখণ্ড ফাঁকা মাঠ আছে। ঐ মাঠের মাঝখানে ছোট একটা চুলা খুঁড়বি, তারপর দাঁতন দিয়ে চুলাটায় আগুন ধরিয়ে হাঁড়িতে চাল আর পানি দিয়ে ভাত চড়িয়ে দিবি। চাল ফুটে ভাত না হওয়া পর্যন্ত একটা করে দাঁতন দিয়ে চুলায় জ্বাল দিতে থাকবি। ভাত হয়ে গেলে হাঁড়িশুদ্ধ ভাত নিয়ে সোজা আমার কাছে চলে আসবি। যদি এই কাজটা করতে পারিস তাহলে আমি আর কোন বাঁধা দেবনা, পরশু থেকেই তোর ব্লাক ম্যাজিকের দীক্ষা শুরু হবে।’ বললেন আহসান সাহেব।
‘ব্যাস এইটুকুই?’, একটু অবাকই হল তপু, ‘আমি তো ভেবেছিলাম খুব কঠিন কোন পরীক্ষা হবে। ঠিক আছে চাচা, ভেবে নাও আমি পরীক্ষায় পাশ করে গেছি।’
‘একটা ব্যাপারে তোকে সাবধান করে দেই তপু, ভাত রান্না করার সময় হয়তো আশেপাশে অনেক রকম শব্দ শুনতে পাবি, হয়তো শুনবি কেউ তোর নাম ধরে ডাকছে কিংবা কেউ হয়তো সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে, খবরদার সেই ডাকে সাড়া দিবিনা, খবরদার। আসলে আমি নিজেও জানিনা ওখানে কি ঘটবে, শুধু বলে রাখছি, সবসময় সাবধান থাকবি’ সাবধান করলেন আহসান সাহেব।
চাচার দিকে তাকিয়ে থাকল তপু। ঠিক বুঝতে পারল না, চাচা তাকে ভয় দেখাচ্ছে না সত্যিই সাবধান করছে তবে যাই হোক না কেন সে ভয় পাবে না, এই পরীক্ষায় তাকে পাশ করতেই হবে।

সাতাশ তারিখ রাত পৌনে এগারটা বাজতে না বাজতেই তপু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে কাদেরগঞ্জ কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। তপুদের বাসা থেকে কাদেরগঞ্জ কবরস্থানে রিকশায় যেতে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। ঠিক পৌনে বারোটায় তপু কবরস্থানের গেটে পৌঁছে গেল। এতক্ষণ প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস থাকলেও, কবরস্থানের ভয়াবহ নিস্তব্ধতা তপুর আত্মবিশ্বাসকে অনেকটা দমিয়ে দিল। দুরুদুরু বুকে কবরস্থানের গেটে আস্তে ধাক্কা দিল তপু। প্রায় নিঃশব্দেই খুলে গেল গেটটা। কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে হাটা দিল তপু। চাচার নির্দেশমতো কিছুক্ষণ চলার পরে অবশেষে ভাঙা কবরটার পাশের ফাঁকা মাঠটা খুঁজে পেল। মাঠটার মাঝখানে ছোট্ট একটা চুলা খুঁড়ল। এরপর চারটা দাঁতন একসঙ্গে ধরিয়ে চুলায় আগুন জ্বালাল। হাঁড়িতে চাল আর পানি দিয়ে চুলার উপর চড়িয়ে দিল। এরপর একটা একটা করে চুলায় দাঁতন দিতে থাকল তপু। সময় যেন খুব ধীরে কাটতে লাগল। তেরটা দাঁতন শেষ, ভাত ফুটতে আর খুব বেশি দেরি নাই। কোথায় যেন একটা কুকুর ডেকে উঠল। অকারণেই শরীরটা একটু ছমছম করে উঠল তপুর। হঠাৎ খেয়াল করল, ওর থেকে বড়জোর সাত-আট হাত দূরে একজন মহিলা বসে একটা চুলা খুঁড়ছে। কোলে একটা বাচচা। ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখার কারণে মহিলার চেহারা দেখতে পারলনা তপু। অবাক হয়ে তপু দেখল, ওই মহিলাটাও ঠিক তারই মত করে দাঁতন দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে ভাত রাঁধতে লাগল। আশ্চর্য, পাশে যে একজন লোক বসে আছে তা যেন মহিলাটা দেখেইনি। আপন মনে একটা একটা দাঁতন দিয়ে চুলায় জ্বাল দিতে থাকল। তপু ঠিক বুঝতে পারেনা, ওই মহিলাও কি তপুর মত কালো যাদু শিখতে চায়? কেন? নিজের কাজ ফেলে সম্মোহনী দৃষ্টিতে মহিলার কাজ দেখতে থাকে তপু।
দেখতে দেখতে মহিলার দাঁতন শেষ হয়ে আসল। চুলার চারদিকে হাত বুলাল কিন্তু জ্বালানোর মত আর কিছু না পেয়ে শেষে নিজের কোল থেকে বাচচাটাকে তুলে নিয়ে চুলার ভিতরে ছুড়ে মারল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা তপু। আর একটু হলেই চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল এই নৃশংস দৃশ্য দেখে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল। ওদিকে মহিলার চুলার আগুন আবার প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আবার মহিলাটা চুলার চারপাশে জ্বালানীর জন্য হাত বুলাল, কিন্তু কিছুই পেল না। হঠাৎ মহিলাটা খ্যাঁনখ্যাঁনে গলায় বলে উঠল, “ দাঁতন পুড়ে শেষ হল, ভাত ফুটল না। নিজের বাচচাটাকে পুড়িয়ে ফেললাম, তাও ভাত হলনা। এইবার ওই মিনসেটাকে পুড়িয়ে ভাত ফোটাবো,” বলে একটানে নিজের ঘোমটাটা খুলে ফেলে তপুর দিকে ঘুরে তাকাল।
মহিলাটা তপুর দিকে তাকাতেই ভয়ের একটা শীতল শিহরন বয়ে গেল তপুর শরীর বেয়ে। কোথায় মহিলা, একটা পিশাচীনি ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে আছে তপুর দিকে। মুখ থেকে মাংস পচে গলে পড়ছে, চোখের জায়গায় দুটো শুন্য কোটর ভয়ংকর ভাবে তাকিয়ে আছে তপুর দিকে। আবার খ্যাঁনখ্যাঁনে কন্ঠে বলে উঠল পিশাচীটা, “ আয়, আমার কাছে আয়। আয় মিনসে, আজ তোকে দিয়েই আমার সাধনা শেষ করব।” বলে শাড়ির ভিতর থেকে একটা লোমশ কুৎসিত হাত বের করে তপুর দিকে বাড়িয়ে দিল পিশাচীটা।

পরদিন। কাদেরগঞ্জ কবরস্থানের গেটের ঠিক সামনে এসে একটা গাড়ি থামল। গাড়ির দরজা খুলে আহসান সাহেব বের হয়ে আসলেন। কবরস্থানের গেট খুলে সোজা পথ ধরে হেঁটে গেলেন। বটগাছটার সামনে যেতেই দেখতে পেলেন অচেতন তপুকে। একটু হাসলেন তিনি। তপুকে ঘাড়ে করে তুলে নিয়ে গাড়ির পিছনের সিটে শুইয়ে দিলেন তারপর গাড়ি ছুটালেন সোজা বাড়ির দিকে।

‘সব কাজ সবার দ্বারা সম্ভব না।’, বিড়বিড় করে বলে উঠলেন তিনি।

মধ্যরাতে কঙ্কালের সাথে। (একখন্ডে সমাপ্ত সম্পূর্ণ রম্য-হরর গল্প)

স্টেশনের লোহার গেটটা এক ধাক্কায় খুলে দৌড় দিলাম টিকিট কাউন্টার এর দিকে। অনেক রাত হয়ে গেছে, ট্রেন পাব কিনা জানিনা। টিকিট কাউন্টারের সামনে যেয়ে হতাশ হতে হল আমকে। বন্ধ। কিন্তু কিছু করার নাই আমার, এইখানে অপেক্ষা করা ছাড়া। একটা টুল দেখে বসে পড়লাম সেখানে। আজকে সকালেই জয়দেবপুর এসেছি একটা ইন্টারভিউ দেয়ার জন্য। এম.বি.এ পাশ করেছি গতবছর। বহু জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। কখনই কোন রিপ্লাই আসেনি। সুতরাং কি হবে তাতো জানিই। বরাবরের মত কোন রিপ্লাই আসবেনা। কিন্তু তাও দিতে আসা, কিছুটা ফর্মালিটি আরকি। এসে পড়লাম বিপদে। ইন্টারভিউ দিতে দিতে বিকেল হয়ে গেল, সেখান থেকে গেলাম এক বন্ধুর বাসায়, সেইখান থেকে রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেল। এখন উল্লুকের মত বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় নাই। কখন ট্রেন আসবে কে জানে। বসে আছি আর মাঝে মাঝেই নিজের শরীরে জোরে থাপ্পড় বসাচ্ছি, মশা তাড়ানোর জন্য। বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি এসে গেছিল। হঠাৎ কানের কাছে কে যেন চিৎকার করে উঠল “ পেয়ে গেছিরে”।
চিৎকার শুনে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম আমি। এবার আমার চিৎকার দেওয়ার পালা। দেখলাম কিম্ভূতদর্শন দুইটা কঙ্কাল আমার সামনে দাঁড়ানো।
“ কি ভেবেছিলিরে টংরা, তুই লুকিয়ে থাকলে আমরা তোকে খুঁজে পাবনা?” একটা কঙ্কাল বলে উঠল।
“ টংরা কে”, বললাম আমি, ভয়ে ঘেমে উঠেছি।
“কে আবার , তুই টংরা। তাড়াতাড়ি চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে যে”, বলল অন্য কঙ্কালটা। এই কঙ্কালটার আবার একটা পা নাই।
“ কোথায় যাব?”
“ যেন কিছু বোঝেনা, তোর আজকে বিয়ে না, তাড়াতাড়ি চল।”
“ বিয়ে!”, চমকে উঠলাম আমি “কিসের বিয়ে, কার বিয়ে?”, গলা দিয়ে ফ্যাস ফ্যাস আওয়াজ বের হল।
“তোর বিয়ে, বট গাছের পেতনীর সাথে। বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে আসলি, আর এখন কিছু বুঝতে পারছিস না?”, বলল একপায়াটা।
“আমি তো মানুষ, আমার পেতনীর সাথে বিয়ে হয় কিভাবে? ”, বললাম আমি।
“কে বলল তুই মানুষ, মড়া মানুষের ভিতর লুকালেই মানুষ হয়ে যায় নাকি?”
“মড়া মানুষ? আরে মড়া পাচ্ছেন কোথায়, আমি তো জলজ্যান্ত মানুষ, দেখছেন না? মরলে আমি টের পেতাম না? ”
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠল একপায়াটা।
“ওরে, মানুষ কখন মরে তা কি সে টের পায়?” বলল সে।
“সে কি তাহলে কি সত্যিই আমি মরে গেছি?” চমকে উঠলাম আমি।
“হ্যারে হ্যা, তুই মরে গেছিস রে, আর আমাদের টংরা তোর পেটের মধ্যে থেকে কথা বলছে।”
চোখে পানি চলে আসল আমার। হায়, জীবনে তো ধরতে গেলে এখনও কিছুই দেখিনি। প্রেম করিনি, নাইট ক্লাবে যাইনি। সবইতো এখনও করা বাকি। শেষ পর্যন্ত কিনা এভাবে বেরসিকের মত মরলাম?
“যেতে কি হবেই?”, একটু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ হবে না আবার?”, ধমক দিল প্রথম ভূতটা “ তোর না গায়ে-গু হয়ে গেছে।”
“গায়ে গু আবার কি?”
“মানুষের যেমন গায়ে হলুদ হয়, তেমনি আমদের হয় গায়ে গু, কিছু বুঝিস না?” বলল প্রথম
কঙ্কাল টা।
হায়, সব আশা বুঝি শেষ। শেষ পর্যন্ত বোধহয় আমকে বট গাছের পেতনীকেই বিয়ে করতে হবে। বট গাছের পেতনী দেখতে কেমন হবে কে জানে? তবু ও একটা শেষ চেষ্টা করা যাক।
“ দেখুন আমি বোধহয় মরিনি, আমকে ছেড়ে দিন”, বললাম আমি।
“ কোন ভূত যখন কোন মড়ার ভিতরে ঢুকে পরে, তখন সেই মড়াটার চেহারা সেই ভূতটার মতো হয়ে যায়। দেখনা, তোর চেহারাও টংরার মতো কেমন অকুৎসিত হয়ে গেছে।”, বলল একপায়াটা।
চেহারা আমার ভালোনা, এটা ঠিক। তাই বলে এমন অপমান? আমাকে বলে অকুৎসিত? মানে কুৎসিতের চেয়েও কুৎসিত?
“ দেখেন ভাল হচ্ছেনা কিন্তু। আমি কোন টংরা ফংরা না”, একটু ঝাঁঝের সাথে বললাম আমি।
“তুই যে টংরা না মানুষ, তার কোন প্রমাণ দিতে পারবি?”
প্রমাণ? একটু ভাবলাম আমি।
“হ্যা পারব।”, বললাম আমি।
“কি প্রমাণ?”
“আমি কবিতা লিখতে পারব। আপনাদের টংরা কি কবিতা লিখতে পারে?”
“ কবিতা?” আবার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল একপায়াটা। “কবিতার নাম শুনলেও তো আমাদের টংরা অশ্বথ গাছে উঠে পালায়। ”
“ব্যাস, এইতো প্রমাণ হয়ে গেল যে আমি টংরা না” খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
“আগে প্রমাণ কর তুই কবিতা লিখতে পারিস, তারপর বুঝব”, বলল প্রথম কঙ্কালটা, “তোর কবিতা কখনও ছাপা হয়েছে?”
“আমার কবিতা এতটা উচ্চমানের, যে সেটা ছাপালে অন্য কবিরা আর সুযোগ পাবে না। তাই ছাপা হয়নি। একজন সম্পাদক নিজের মুখে আমাকে একথা বলেছেন।” গর্বের সাথে বললাম আমি।
“দেখি লেখতো একটা কবিতা। আমার নাম নিয়ে একটা কবিতা লেখ।”, বলল প্রথম কঙ্কালটা।
“নাম কি আপনার?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“কানাবেল”, বলল প্রথম কঙ্কাল টা।
“আহা, নামের কি বাহার!”, মনে মনে বললাম আমি।
যাই হোক ব্যাগ থেকে কাগজ কলম নিয়ে বসে গেলাম কবিতা লিখতে।
কিছুদূর লেখার পর জিজ্ঞেস করল কঙ্কালটা, “কিরে লেখা হল?”
“হ্যা শেষ।”
“পড়তো দেখি।”
একটু গলা খাঁকারি দিয়ে পরতে শুরু করলাম আমি,
“তেল আছে, টেল আছে
আর আছে কদবেল,
মেল আছে, জেল আছে
আর আছে পাস ফেল।
খুন আছে, চুন আছে
আর আছে বানডেল
সবচেয়ে মহান হল
কঙ্কাল কানাবেল।”

“ বাহ বাহ”, আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল কানাবেল।
“তাহলে প্রমাণ হলোতো যে আমি টংরা না?”, জিজ্ঞেস করলাম আমি।
কি যেন বলতে যাচ্ছিল কানাবেল, কিন্তু তার আগেই চিৎকার করে উঠল একপায়াটা, “পেয়েছি পেয়েছি টংরাকে, ওই যে অশ্বথ গাছের উপরে।”
কানাবেল আর একপায়া দৌড় দিল গাছটার দিকে।

আমিও আল্লাহর নাম নিয়ে একছুটে স্টেশন পার হয়ে শহরের দিকে ছুটলাম।

আস্তিক - একখন্ডে সমাপ্ত সম্পূর্ণ পিশাচ কাহিনী

আমার নাম রহমান। জুয়েল রহমান। পেশায় ডাক্তার। থাকি ঢাকায়। আমি ভূত বিশ্বাস করি না। ভূত কেন আমিতো ঈশ্বরকেও বিশ্বাস করিনা। যে সময় মানুষ চাঁদে যাচ্ছে, মঙ্গলগ্রহ জয় করার প্রস্তুতি নিচ্ছে , সেই যুগে আমি ভূত নামক মানুষ সৃষ্ট একটা ভ্রান্ত ধারণাকে মনে ঠাঁই দিতে পারিনা। আমার বন্ধুরা আমকে নাস্তিক বলে। বলুক। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আমি আমার বিশ্বাসে অটল। কেউ টিটকারি দিয়ে আমকে আমার বিশ্বাস থেকে একটুও নড়াতে পারবেনা। আমি নাস্তিক। একজন নাস্তিক মানুষ।
6 জুলাই, 2006। রাতে ডিনার করে ইজিচেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিলাম। এসময় বিকট শব্দে বেজে উঠল আমার পুরনো আমলের টেলিফোন সেটটা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবিরের কন্ঠস্বর। কাজ করে করে একেবারে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আবিরকে বলেছিলাম কক্সবাজারের একটা টিকিট কনফার্ম করে রাখতে। একারনেই ফোন করেছে ও। পরশুদিন বিকাল 5 টায় ফ্লাইট। খুশি হয়ে উঠল মনটা। যাক কয়েকটা দিনতো অন্তত নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিতে পারব।
8, জুলাই। যথাসময়ে রওনা দিলাম আমি। চট্টগ্রাম পৌঁছতে সন্ধ্যা 7টা বেজে গেল। ট্যাক্সির খোঁজে এদিক ওদিক তাকাতেই একটা ট্যাক্সি এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। ট্যাক্সির ড্রাইভারের বয়স বড়জোর 26 কি 27 হবে। কক্সবাজার যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম। যাবে। উঠে বসতেই ট্যাক্সি ছাড়ল ও কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম। কিন্তু কতক্ষণ আর চুপচাপ বসে থাকা যায়? তাই ঠিক করলাম ড্রাইভার ছেলেটার সাথেই আলাপ জমাবো।
“নাম কি তোমার?“ আলাপ জমানোর প্রথম পদক্ষেপ হল প্রথমে অন্যজনের নাম জিজ্ঞাসা করা, তাই নাম দিয়েই আলাপ শুরু করলাম আমি।
“জনি,“ একটু হেসে উত্তর দিল সে।
ওর কাছ থেকে জানলাম ও গ্রাজুয়েশন করেছে। কিন্তু কোনও চাকরি না পেয়ে শেষে ট্যাক্সি চালানো শুরু করেছে। আলাপ করতে করতেই চারদিকের অন্ধকারাচছন্ন দৃশ্য দেখতে লাগলাম আমি। এক ঘন্টা হয়ে গেছে প্রায়। সিটে হেলান দিয়ে ঝিমাতে লাগলাম আমি। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে উঠে বসলাম।
“কি ব্যাপার, জনি?“ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“টায়ার পাংচার হয়ে গেছে, স্যার। গাড়িতে এক্সট্রা কোন টায়ারও নাই,“ বিব্রত ভঙ্গিতে উত্তর দিল জনি।
“সেকি? এখন কি করব?“ কিছুটা রাগতো স্বরে বললাম আমি।
“একটা ফোন করা লাগবে, স্যার“।
“ ফোন এখানে কোথায় পাব। নির্জন রাস্তা ছাড়া কোনও বাড়িঘর বা দোকানপাটতো চোখে পড়ছেনা।“ বললাম আমি।
হঠাৎ একদিকে আঙুল তুললো জনি “ঐ দেখেন স্যার একটা বাড়ি“।
ওর নির্দেশিত দিকে তাকালাম আমি। সত্যিই তো একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে।
“জনি চলতো দেখি ওই বাড়িতে টেলিফোন পাওয়া যায় কিনা?“ বললাম আমি।
বেশী দূরে না বাড়িটা। তবে আমদের অবস্থান থেকে বাড়িটা পর্যন্ত ঘন ঝোপঝারে ভরা। বাড়িটাতে পৌঁছে চারদিকে তাকালাম দরজার খোঁজে। পেয়েও গেলাম দরজাটা। ডোরবেলের খোঁজ করলাম দরজার আশেপাশে, কিন্তু পেলাম না।
“চুলোয় যাক ডোরবেল,“ বলে দরজায় নক করল জনি। ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। এবার জোরে জোরে দরজায় বাড়ি দিতে লাগল ও। একটু পর ভিতর থেকে মৃদু পায়ের আওয়াজ পেলাম। ভীত মুখে বয়স তিরিশেক একজন মহিলা দরজা খুলে দিল। সন্দেহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমদের দুজনকে দেখল।
“কে আপনারা?“ ভীত কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
আমি আমাদের সব সমস্যার কথা খুলে বলতেই ভিতরে ডাকলেন আমাদের। তারপর জনকে দেখিয়ে দিলেন কোন ঘরে টেলিফোন আছে। জন চলে গেল টেলিফোন করতে। ভদ্রমহিলা আমাকে সোফায় বসতে বললেন। বসে থেকে ঘরের চারদিকে চোখ বুলাতে লাগলাম আমি। দেয়ালে দেখলাম ঐ ভদ্রমহিলা এবং এক ভদ্রলোকের ছবি। আমাকে ছবির দিকে তাকাতে দেখে মহিলা নিজেই বললেন “উনি আমার স্বামী, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।”
“ওহ! আমি দুঃখিত।” উঁনাকে এই বিষয়ে আর কোন প্রশ্ন করে বিব্রত করতে চাইলামনা।
“ আপনারা বসুন, আমি চা নিয়ে আসি,” আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। জনি এখনও আসেনি। চুপচাপ বসে আছি। এমন সময় সামনের ঘরের দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে বের হয়ে আসলো একজন লোক। তাকে দেখেই চমকে উঠলাম আমি। চট করে ছবির দিকে তাকালাম, না কোনও সন্দেহ নেই। ছবির ঐ ভদ্রলোক। ভদ্রলোক আমাকে দেখে অবাক হলেন।
“কে আপনি, আমার বাসায় ঢুকলেন কীভাবে?”এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
“আপনি,” ওনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “আপনি জীবিত আছেন? কিন্তু উনি যে বললেন.........”
“আমি জীবিত আছি মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি,” বিস্ময় ফুটে উঠল তার চেহারায়।
“আপনার স্ত্রী বললেন আপনি মারা গেছেন,” বললাম আমি।
রাগ ফুটে উঠল তার চেহারায়,“ইয়ারকি করছেন আপনি আমার সাথে? কি যাতা বলছেন আমার মৃতা স্ত্রী সম্পর্কে?”
“মৃতা স্ত্রী,” বোমা ফাটল যেন আমার কানের পাশে,“কি সব উল্টো পাল্টা কথা বলছেন আপনি, আপনার স্ত্রী তো বেঁচে আছেন। চা বানাতে গেছেন আমাদের জন্য,“ চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
“দেখুন যথেষ্ট হয়েছে, একেতো বিনা অনুমতিতে আমার বাড়িতে ঢুকেছেন, আবার আমার মৃতা স্ত্রী সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলছেন। আমি..........।” কথা শেষ করতে পারলেননা উনি কারণ জনি এসে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। অবাক হয়ে জনির দিকে তাকালেন তিনি।
“তুমি কে,” তার কন্ঠে স্পষ্ট বিরক্তি “ কেউ কি আমকে বলবে কি হচেছ এখনে?”
“দেখুন মিস্টার....... ,”
“আমান, আমি আমান চৌধুরি,” ধরিয়ে দিলেন তিনি।
“ওকে, মিস্টার আমান চৌধুরি, দেখুন আমদের গাড়ির টায়ার আপনার বাড়ির সামনে এসে পাংচার হয়ে যায়, আমরা আপনার দরজা নক করতে আপনার স্ত্রী দরজা খুলে দেয় আর আমকে এখানে বসায়ে রেখে উনি চা বানাতে গেছেন, দয়া করে রান্নাঘরে যেয়ে উনাকে জিজ্ঞাসা করুন।”
“আমি জানিনা আপনি কি বলছেন, কিন্তু আমার স্ত্রী গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন,” বললেন আমান চৌধুরি।
“What the hell you are talking about,” প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “আমরা একটু আগে উনার সাথে কথা বলেছি, জনি তুমিই বল।”
“ আমি জানিনা আপনারা নেশা করেছেন কিনা কিন্তু আমার স্ত্রী গতবছরই মারা গেছে।”
“Please trust me, MR. Aman, আমরা দুজন একসাথে ভুল দেখতে পারিনা।”
“তাহলে আপনারা নিশ্চয়ই ওর আত্মাকে দেখেছেন,” রাগ সরে গিয়ে হাসি হাসি হয়ে উঠল তার মুখটা।
“আত্মা! কি বলছেন আপনি?”
“ঠিকই বলছি, কারণ এখন আমি ওর আত্মাকে আপনাদের পিছনে দেখতে পাচ্ছি।”
পিছনে ঘুরেই চমকে গেলাম আমরা, ঐ মহিলাই হাস্যজ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
“সরি মিস্টার..... , ওহ আপনার নামটাই তো জানা হয়নি, যাইহোক আমি পলি চৌধুরী, আমানের স্ত্রী।” হাসিমুখে বললেন উনি।
“ আমরা সত্যিই দুঃখিত মিস্টার.......” জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে আমান চৌধুরি তাকালেন আমার দিকে।
“রহমান, আমি জুয়েল রহমান।” নাম বললাম আমি।
“ওকে, মিস্টার জুয়েল রহমান, আমরা সত্যিই দুঃখিত, জাস্ট একটু ফান করলাম আপনাদের সাথে।”
“ফান?” বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“হ্যা, ফান। আসলে আমরা দুজন লোকালয় থেকে অনেক দূরে থাকি। দুজনের সংসার। জরুরী কাজ ছাড়া শহরে যাওয়া হয় না খুব একটা। মানুষের সাথে খুব বেশী মেশাও হয় না। একেবারে রসকষহীন জীবনযাপন করি। তাই জানালা দিয়ে আপনাদের আসতে দেখে ভাবলাম একটু ফান করা যাক। তাই দুজনে একটু ভূতের অভিনয় করলাম। যাইহোক ভাই, কিছু মনে করেন না।” হাসলেন আমান চৌধুরি।
হাসলাম আমিও। এতক্ষণে সব বুঝতে পারলাম। জনির মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল এইসব কাণ্ড কারখানা দেখে। এবার সব কিছু বুঝতে পেরে শান্ত হয়ে আমার পাশে এসে বসল। মিসেস আমান আমাদের চা নাশতা পরিবেশন করলেন।
একটু পর দরজায় শব্দ হল। মেকানিক এসে গেছে। দশ মিনিটও লাগলনা টায়ার পাল্টাতে। মিস্টার এবং মিসেস আমানকে বিদায় জানায়ে আমি আর জনি আবার রওনা হলাম।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বেজে গেছে।
“স্যার, খুব ভয় পেয়েছিলেন বুঝি,” জনি জিজ্ঞেস করল।
“ভয়? হেসে উঠলাম আমি। “এই জুয়েল রহমান কখনও ভয় পায়না, জনি। আমি যদি পৃথিবীতে কিছু অবিশ্বাস করি তা হল ভূত আর ঈশ্বর।”
জনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তাকাক। সবাই তাকায়। আমার এতে কিছু যায় আসে না।
“স্যার, ভূতও আছে, ঈশ্বরও আছে। আপনি এটা অস্বীকার করতে পারেননা।”
জনির কথার ধরন দেখে অবাক হলাম।
“আচ্ছা? তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে?কীভাবে তুমি এত জোর গলায় বলছ যে ভূত আছে?”
হঠাৎ গাড়ি একটা জোরে ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল। আমার দিকে ঘুরলো জনি। ধ্বক করে উঠল আমার বুকটা। দেখলাম যেখানে জনির চোখজোড়া ছিল সেখানে এখন শুধু শুন্য কোটর ভয়ংকর ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আমি এত জোর দিয়ে বলছি কারণ আমি নিজেই ভূত, স্যার।” ঘড়ঘড়ে কন্ঠে বলল জনি।
হঠাৎ দেখলাম জনির চামড়া আস্তে আস্তে খসে পরতে লাগল। ঠোঁট দুটো খসে গিয়ে সেখানে উঁকি দিল ভয়ংকর কাল দাঁতসহ কুৎসিত লাল মাড়ি। পচা মাংসের তীব্র গন্ধে ভরে গেল গাড়ির ভিতরটা। কিছুক্ষণ পরে ওর দেহে আর মাংস বা চামড়া বলে কিছু থাকল না। শুধু একটা ভয়ংকর কঙ্কাল বিদঘুটে ভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকল। অজান্তেই তীব্র চিৎকার বেরিয়ে আসল আমার গলা থেকে। কিন্তু এই নির্জন জায়গায় আমার চিৎকার শোনার কেউ নাই। গাড়ির দরজা খোলার চেষ্টা করলাম কিন্তু হাতদুটো যেন অসাড় হয়ে গেছে, যেন কেউ সম্মোহিত করে রেখেছে আমকে। আবার কুৎসিত কঙ্কালটার দিকে তাকালাম। দেখলাম ধীরে ধীরে ওটা একটা কুৎসিত হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার দিকে।


9 জুলাই। সন্ধ্যা 7 টা বাজছে প্রায়। আমি চট্টগ্রাম এয়ারপোর্টের সামনে ট্যাক্সির ভিতর বসে আছি। অপেক্ষা করছি একজন প্যাসেঞ্জারের জন্য। শুধু আমি না আমার মত আরও অনেক ভূত অপেক্ষা করছে ট্যাক্সি নিয়ে। একজন প্যাসেঞ্জার পেলেই তাকে নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাব। চট্টগ্রাম হাইওয়ে থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটা নির্জন জায়গায় নিয়ে তাকে খুন করব যেভাবে জনি কাল আমকে খুন করেছিল।
আস্তেআস্তে প্রচুর ভূত বাড়াতে হবে আমাদের দলে। আফটারঅল কিছুদিন পরে পৃথিবীর সব মানুষ খুন করে আমরা ভূতেরাই তো পৃথিবীর উপর রাজত্ব করব। এখন আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। এখন আমি আস্তিক। একজন আস্তিক ভূত।

হ্যালোইনের রাত (একখন্ডে সমাপ্ত সম্পূর্ণ পিশাচ কাহিনী

.........................
.........................
.........................



হ্যালোইনের জঙ্গল পার্টিতে অংশগ্রহন করতে এসেছে ওরা তিন বোন। এঞ্জেলা, নিনা আর মিশেল। নিনা আর মিশেল বয়সে বড়, এঞ্জেলা ওদের অনেক ছোট। ১৬ বছরে পড়ল এবার। বাইরের জগৎ সম্পর্কে একেবারেই অসচেতন। দুই বোনের সাথে এবার প্রথমবারের মতো যোগ দিচ্ছে হ্যালোইন জঙ্গল পার্টিতে।

পার্টিতে যারা অংশগ্রহন করবে সবাই এসে গেছে। কিছু বয়স্ক দম্পতি, কয়েকজন ইয়াং ছেলেমেয়ে, বাচ্চাকাচ্চা আর এঞ্জেলারা তিন বোন-সব মিলে মোটের উপর ৩৫-৪০ জন হবে। ঠিক রাত ১০-৩০ মিনিটে বাস ছেড়ে দিবে। এঞ্জেলারা তিন আসনের একটা বেঞ্চ দখল করে বসে গেল। বাসের মধ্যে বাচ্চাদের হৈচৈ আর অন্যান্নদের উল্লাস চিৎকারে কান ঝালাপালা হয়ে আসছে। অনেকেই ভ্যাম্পয়ার আর ওয়্যারউল্ফের মুখোস পড়ে একে অন্যকে হাস্যকর ভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এঞ্জেলা বসেছে সীটের করিডর সাইডে। লাল একটা হুডওয়ালা গাউন তার পরনে। চুপচাপ বসে আছে ও। ব্যাপারটা চোখ এড়ালোনা নিনার।

"কি হয়েছে তোর," নিনা জিজ্ঞেস করলো।
এঞ্জেলা ইশারায় পিছনে বসা ভ্যাম্পায়ারের মুখোশ পড়া এক লোককে দেখালো, যে এক দৃষ্টিতে এঞ্জেলার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকানোর ভঙ্গিটা কেমন যেন রহস্যময়, কিছুটা ভয়ঙ্করও।

নিনা এঞ্জেলাকে লোকটার দিকে তাকাতে মানা করলো। ছোট বোনটা সুন্দরী, বেশ সুন্দরী। লোকজন একটু লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাতেই পারে। এতে ওদের যায় আসে না। আজ হ্যালোইনের রাত। ওরা তিনবোন আজ খুব এনজয় করবে, শুধু ওরা তিনজন।

রাত ১২-০৪ মিনিটে বাস এসে পৌছালো শহরের বাইরে অবস্থিত "উল্ফ ফরেস্ট" নামক জঙ্গলের সামনে। নেকড়ে আর ভালুকের অভয়ারন্য এই বন। তবে ওরা বেশ ভিতরের দিকে থাকে। জঙ্গলের এই দিকটাতে আসে না বললেই চলে।

হৈচৈ করতে করতে সবাই বাস থেকে নেমে পড়লো। আগে থেকেই ৪ জন লোক পাঠানো হয়েছিল। তারা ক্যাম্পের ব্যাবস্থা করেই রেখেছে। বয়স্ক লোকেরা ক্যাম্প ফায়ারের ধার ঘেষে বসলো, বাচ্চারা এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করতে লাগলো। যুবক যুবতীরা যুগল ভাবে ঘুরতে লাগল এদিক সেদিক। কিন্তু ভাম্পায়ারের মুখোশ পরা রহস্যময় লোকটাকে কোথাও দেখা গেলনা।

নিনা ওর ছোট দুই বোনকে নিয়ে বনের ভেতর দিকে ঘুরতে বের হলো। বিশাল এক পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে আকাশে। এত সুন্দর দৃশ্ব্য আগে কখনও দেখেনি এঞ্জেলা । আকাশ আর পূর্ণিমার আলোয় স্নান করা জঙ্গল দেখতে দেখতে দুই বোনের পিছন পিছন যেতে লাগলো ও। সৌন্দর্য দেখতে এতই ব্যাস্ত ছিল যে কখন বোনদের ছেড়ে পথ হারিয়েছে বুঝতে পারেনি এঞ্জেলা। যখন বুঝতে পারলো তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। চারদিকে তাকিয়ে চমকে উঠল এঞ্জেলা। আশেপাশে কেউ নেই। একদম নিশ্চুপ বনভূমি। বোনদের কাছে শোনা গল্পগুলো মনে পড়ে গেল এঞ্জেলার। হ্যালোইনের এই রাতে জেগে ওঠে সব দানোবেরা। ভ্যাম্পায়ার আর ওয়্যারউল্ফরা মেতে ওঠে রক্তখেলায়।

শরীরটা একটু ছমছম করে উঠল এঞ্জেলার। পিছনে একটা শব্দ হতেই ঘুরে তাকালো ও। প্রথমে কিছুই দেখতে পেল না। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলো মুখোশ পরা সেই লোকটা একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুখোশের ভিতর থেকে লোলুপ চোখদুটো এঞ্জেলার দিকে তাকিয়ে নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে হাসছে যেন। প্রচন্ড ভয় পেল এঞ্জেলা। বুকের ভিতর হৃৎপিন্ডটা প্রচন্ড ভাবে লাফাচ্ছে। লোকটা ধীরে ধীরে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। এঞ্জেলা পিছাতে শুরু করলো। হঠাৎ ঘুরে দৌড়াতে শুরু কররো ও। মুখ থেকে মুখোশটা খুলে ফেলল লোকটা তারপর পিছু নিল এঞ্জেলার।


হাটতে হাটতে অনেক দূর এসে খেয়াল হলো এঞ্জেলা নেই ওদের সাথে। চমকে উঠলো ওরা দুইবোন। চারদিকে খোঁজ করতে লাগলো এঞ্জেলার। কিন্তু কোথাও নেই। ভয় পেয়ে গেল মিশেল।
"কোথায় যেতে পারে এঞ্জেলা?" ভীত কন্ঠে প্রশ্ন করলো ও।
"জানিনা, বনের মধ্যে পথ হারানো অস্বাভাবিক কিছুনা" অনিশ্চিত কন্ঠ নিনার, "চলো আরো ভালো করে খুজে দেখি।"

খুজতে খুজতে বনের আরো গভীরে চলে আসলো ওরা। হঠাৎ একটা কিছুতে পা বেধে পড়ে গেল নিনা। উঠে দাড়িয়েই তাকালো জিনিষটার দিকে। মানুষের আকৃতির কিছু একটা পড়ে আছে। এগিয়ে গেল ওটার দিকে। ভালো করে তাকাতেই চিনতে পারলো জিনিষটা। এঞ্জেলার গাউন। হুড দিয়ে মুখটা ঢাকা। ততক্ষনে মিশেলও চলে এসেছে। ফুঁপিয়ে কেদে উঠল সে। পড়ে থাকা বডিটার মুখ থেকে খুব ধীরে হুডটা সরালো নিনা।
তাকালো বডিটার মুখের দিকে।

না, এঞ্জেলা নয়। একজন যুবক ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে এঞ্জেলার গাউনের ভিতর থেকে।

"আমাকে বাঁচাও," ফিসফিস করে বলে উঠলো যুবকটা।
"কে তুমি, কি হয়েছে তোমার?" নিনা জিজ্ঞেস করলো।
"ও, ওই মেয়েটা..." বলে পিছন দিকে আঙ্গুল তুললো লোকটা।

ঘুরে তাকালো নিনা আর মিশেল। পেছনে দাড়িয়ে আছে এঞ্জেলা। চোখে বিস্মিত দৃষ্টি। একটা হালকা নীল রঙের টি-শার্ট আর সাদা স্কার্ট ওর পরনে। গাউনের ভিতরে এগুলো পড়ে ছিল সে, যেটা এখন লোকটার গায়ে জড়ানো। এঞ্জেলার দিকে এগিয়ে গেল নিনা।

"তোমাকে বলেছিলাম না আমাদের সাথে সাথেই থাকতে?"
"আমি পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম।" ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল এঞ্জেলা, "আর ঐ লোকটা.........."
"ভালোই তো," লোকটার দিকে তাকিয়ে হাসলো নিনা, "দারুন এক সুদর্শন যুবককে পেয়েছ তুমি। দারুন ভাগ্য তোমার।"
"কিন্তু আমি যে কিছুই পারিনা, কোনই অভিজ্ঞতা নেই আমার।" এঞ্জেলা বলল।
"তাতে কি? আমরা সবাই-ই নতুন ছিলাম কোন না কোন সময়। ওর কাছে যাও, এঞ্জেলা। তোমার উষ্ণ ছোঁয়া দাও ওকে।"

একটু ভাবলো এঞ্জেলা। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল লোকটার দিকে। যুবকটা তাকিয়ে থাকলো রূপসীনির দিকে। এঞ্জেলা সরাসরি লোকটার শরীরের উপর উঠে বসলো। সামান্য ভয় কাজ করছে ওর মধ্যে। কিন্তু ভয়টা কাটিয়ে উঠল ও। একটানে নিজের টি শার্ট টা খুলে ফেলল। যুবকের মধ্যে আবার সেই লোলুপতা ফিরে আসলো। লোভনীয় চোখ নিয়ে তাকালো এঞ্জেলার অন্তর্বাস পড়া শরীরের দিকে।

কিন্তু একি! হঠাৎ করেই যেন এঞ্জেলার শরীরে গজাতে লাগলো ঘন কালো লোম। ঘনঘন শ্বাস নিতে থাকলো সে। চোখের নীল মনি হঠাৎ পরিনত হলো হলুদ বর্ণে। ফাঁক হয়ে গেল এঞ্জেলার মুখটা, চোয়ালের কোনার দুই দাঁত প্রথমে সরু আকার ধারন করলো তারপর অনেকটা লম্বা হয়ে গেল, অনেকটা শ্বাপদ প্রাণীর দাঁতের মতো। চাঁদের আলোয় ঝিকিয়ে উঠলো দাঁতদুটো। মুহুর্তে বদলে গেল তার সুন্দর মুখখানা। নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর এক পিশাচীনিতে পরিনত হলো সে। রাতের নিঃশব্দতা ভেদ করে কুৎসিত ভয়ঙ্কর কন্ঠে চিৎকার করে উঠল পিশাচীনি। তারপর মুখটা নামিয়ে আনলো যুবকের ঘাড়ের কাছে। সুচাঁলো দাঁতদুটো ফুটিয়ে দিল যুবকের দপদপ করতে থাকা ঘাড়ের রগে। তারপর অভুক্তের মতো চুষে খেতে লাগলো যুবকের গরম তরল রক্ত যেন অনন্তকাল ধরে ভীষন, ভীষন পিপাসার্ত সে।

ভোর হয়ে আসছে। পার্টির লোকজন ফেরার জন্য বাসে উঠে পড়েছে। এঞ্জেলারা তিনবোন নিজেদের আগের সেই সীটেই বসে নিজেদের মধ্যে আড্ডায় জমে উঠেছে। বাচ্চা আর যুবক-যুবতীদের কোলাহলে মুখর হয়ে আছে বাসের ভিতরটা।

কিন্তু কেউ খেয়াল করলো না, আসার সময় বাসটার সবগুলো আসন একেবারে পরিপূর্ণ থাকলেও, যাওয়ার সময় একটা আসন যাচ্ছে একদম ফাঁকা।

বাসটা রওনা হতেই জঙ্গলের ভিতর থেকে করুন কন্ঠে বিলাপ করে উঠল একটা নেকড়ে, যেন বিদায় জানালো হ্যালোইনের ভয়ঙ্কর রাতটাকে।

///ফোঁড়া /////// রহস্য- রোমাঞ্চ- ভৌতিক গল্প

ফোঁড়া /////// ২২-০৮-২০১১


অনেক ক্ষন ধরে সামনে বসা মানুষ টার দিকে তাকিয়ে আছেন ডঃ তাহসিনা। মাথাটা নিচু করে বসেই আছে সেই লোক। অনেকক্ষণ ধরে বসে থেকে থেকে শেষে বলতে শুরু করল-

"আমার যে সমস্যা সেটা হল আমার পেটে একটা ফোঁড়া ঊঠেছে।"
বলেই শুন্য দৃষ্টিতে ডঃ তাহসিনার দিকে তাকিয়ে থাকল। ডঃ তাহসিনা অনেক ভাল একজন সাইকায়াট্রিষ্ট। উনি এর আগে ও অনেক মেন্টাল রুগীকে ভাল করেছেন। কিন্তু আজকের এই রুগি এসে বসেছে তো বসেছে কথা বলার কোন নাম গন্ধ নাই। অনেক ক্ষন মাথা নিচু করে চুপ করে থেকে শেষে বলতে শুরু করল।

" আমার সমস্যার শুরু যখন আমি আমার স্ত্রি মাহমুদা কে খুন করি। আমার স্ত্রি কে নিয়ে আমি খুব সুখে ছিলাম। কিন্তু আমার একটা এক্সিডেন্টের কারনে ডাক্তার আমাকে বলেন যে আমি আর কোন দিন বাবা হতে পারবোনা। এর পর মাহমুদা আমাকে প্রথম প্রথম মেনে নিয়েছিল। আমাদের বিয়ে হবার পর ঠিক করেছিলাম ৩ বছর পর বাচ্চা নেব। এর মাঝেই ঘটে যায় সেই এক্সিডেন্ট। এরপর মাস ছয়েক ঠিক ছিল। কিন্তু একদিন আমি জানতে পারি মাহমুদার সাথে আমার এক আত্মীয়র অবৈধ সম্পর্ক হয়েছে। এটা শোনার পর আমার মাথা ঠিক ছিলনা। আমি দুইবার আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। এর মাঝেই আমাকে মাহমুদা ওর অবৈধ সম্পর্কের কথা জানায়। আমি বিমূঢ় ছিলাম বেশ কিছু দিন। কিন্তু এর মাঝেই জানতে পারি মাহমুদা কনসিভ করেছে। এটা শুনে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। ওর পেটে বাচ্চা যখন ৮ মাস - তখন আমি একদিন মাহমুদা কে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলি। মেরে ফেলি পেটের বাচ্চা টাকে ও। আমি একজন পুলিশ অফিসার ছিলাম সেই সময়। এখন আমি রিটায়ার্ড। সেই সময় আমার ক্ষমতা বলে মাহমুদা কে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কোন রকমে দাফন করে আসি। এর পর আমি অনেক দিন দেশের বাইরে ছিলাম।" বলেই একবার দম নিল লোকটা। তারপর টেবিল থেকে পানির জগটা নিয়ে অদ্ভুত ভাবে পানি গ্লাসে না ঢেলে জগ থেকেই ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল অর্ধেক পানি।

তারপর আরেকটা দম নিয়ে আবার বলা শুরু করল সে -
" এর পরের বছর আমি দেশে ফিরে আসি। চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছিলাম। সেখানে আবার জয়েন করি। কিন্তু দুই মাস আগে আমি ঈদের ছুটিতে গ্রামে যাই। সেখানে ঈদের দিন রাতে আমি একাকী বসে ছিলাম আমার বাড়ির পেছনের বারান্দায়। তখন দেখি মাহমুদার কবর থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বাবা বাবা করে ডেকে আমার দিকে দৌড়ে এসে আমার মাঝে ঢুকে গেছে।

সেদিন রাতে আমি খানিকটা নেশা করেছিলাম। তাই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সব আজগুবি মনে করে ভুলে যাই। কিন্তু পরদিন আমার পেটে নাভীর গোড়ায় একটা ফোঁড়া ঊঠে। প্রথমে এটা ফোঁড়ার মতই ছিল কিন্তু আস্তে আস্তে এটা বড় হতে থাকে। আমি এই কয়দিন প্রায় সময় স্বপ্নে দেখছি একটা বাচ্চা ছেলে আমাকে বাবা বাবা করে ডাকছে আর বলছে আমার পেট থেকে নাকি তার জন্ম হবে। এই যে দেখেন আমার পেটের মাঝে এটা কি”- বলে শার্টের ভাজ খুলে দেখায় ডঃ তাহসিনাকে।
তাহসিনা কিছুক্ষন দেখেন ফোঁড়া টা। বেশ বড় আকারের একটা ফোঁড়া। লালচে ভাব ধরেছে। তারপর হেসে লোকটাকে বললেন-

“দেখুন মি.”- বলে নামটা জানার জন্য তাকালেন উতসুক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে।
উনি বললেন “ রাকিব- মোঃ রাকিব”।

“হুম – দেখুন রাকিব সাহেব- আপনার হ্যালুসিনেশন হয়েছিল- সেই দিন রাতে। আপনি আপনার স্ত্রীকে অনেক ভালবাসতেন। সেই ভালবাসা আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। তাই আপনি উনাকে এবং উনার সন্তান কে মেরে ফেলে অনেক কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেইদিন আপনার পিতৃসত্ত্বা আপনার মাঝে আপনার মৃত সন্তান কে ঢুকে যেতে দেখিয়েছে। এটা নিছক ই কল্পনা। আর বেশি কিছু না”। বলে মিষ্টি করে হেসে রাকিব সাহেবের দিকে তাকালেন।

“ কিন্তু আমার পেটের এই ফোঁড়া কিভাবে আসল?” এবার ক্ষেপে গেলেন রাকিব সাহেব।

“এটা কো- ইন্সিডেন্স মাত্র। এটার সাথে আপনার স্বপ্ন কিনবা হ্যালুসিনেশন কে মেলালে তো চলবেনা”-বললেন ডঃ তাহসিনা।

“ দেখেন আমি মেলাচ্ছিনা। কিন্তু ইদানিন আমার পেটের ভেতর কিছু একটা লাথি মারে। কিছু একটা হচ্ছে আমার পেটের ভেতর”- বলেই প্রায় কেঁদে ফেলে রাকিব সাহেব।

“ দেখুন আপনাকে আমি কিছু ঔষধ লিখে দিচ্ছি।এগুলো খান। আশা করি আপনার ভাল ঘুম হবে। এবং আপনার এই বিশাল ফোঁড়া ও কমে যাবে” বলেই খস খস করে কিছু ঔষধ লিখে প্যাড থেকে কাগজ ছিড়ে দেন রাকিব সাহেব কে।

তারপর বললেন-“ আপনার যে কোন সমস্যা হলে আমি নিজে গিয়ে আপনাকে দেখে আসব। আপনার এখানে আসার আর দরকার নেই। এইখানে আমার ফোন নাম্বার দেয়া আছে। সেখান থেকে আমাকে ফোনে জানাবেন কি হয়েছে”- বলেই ঊঠে পড়লেন ডঃ তাহসিনা।

“আমার একটা সেমিনার আছে- আমাকে এখন সেখানে যেতে হবে” বলে বের হয়ে গেলেন ডঃ তাহসিনা।
..............

তিন মাস পর রাত ১টায় ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল ডঃ তাহসিনার। উনি ফোনটা ধরেই আরেক পাশ থেকে শুনতে পেলেন- রাকিব সাহেবের কন্ঠ-

“ আপা একটু আসবেন আমার বাসায়? প্লিজ আপা আসেন।প্লিজ আসেন। আমার পেটে প্রচন্ড ব্যাথা করছে” বলেই বাসার ঠিকানা দিলেন ডঃ তাহসিনাকে।

সারাদিন মেডিক্যাল এ সেমিনারে ছিলেন তিনি। তাই বাসায় এসে মাত্র শুয়েছেন। কিন্তু এই রকম কল এলে প্রায় সময় তিনি ঘুম রেখেই দৌড় মারেন রূগীর বাসায়। নিজের জীবনের চেয়ে রোগীকে অনেক গুরুত্ব দেন তিনি। আর এই রাকিব সাহেবের ব্যাপারটা নিয়ে তিনি অনেক পড়াশুনা করেছেন ইদানিন। তাই তিনি এত রাতে ফোন পেয়ে কোন রকমে পোশাক পাল্টে গাড়ি নিয়ে বের হলেন।

রাকিব সাহেবের বাসায় বাসা গুলশানে। সেখানে পৌছে একটা সাদা রঙ এর বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে নিজেই ঢুকে পড়লেন ভেতরে। বাড়িতে গিয়ে বেল টেপার পর খুলে দিল একজন বৃদ্ধা মহিলা। তিনি রাকিব সাহেব কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই মহিলা তাহসিনাকে নিয়ে গেলেন একটা ঘরে। সেখানে শুয়ে আছেন রাকিব সাহেব।

কিন্তু রাকিব সাহেব কে দেখেই ভয় পেয়ে যান তিনি।রাকিব সাহেবের পেটটা অস্বাভাবিক ভাবে ফোলা। ঠিক যেন সন্তান সম্ভবা মায়ের মত। আর ঠিক সেই সময় রাকিব সাহেব চিৎকার করে ঊঠে অজ্ঞান হয়ে যান। এবং সেই সময় তাহসিনার চোখের সামনে ঘটল এক বিষ্ম্য় কর ব্যাপার। রাকিব সাহেবের নাভির উপরের ফোঁড়া থেকে একটা লালচে পিণ্ড বের হতে লাগল। আস্তে আস্তে পিন্ড টার কিছু অংশ বের হয়ে চোখ আর মুখে অস্তিত্ব জানান দিল। এর পর তাহসিনা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে দেয়া মহিলা কে গামছা আর কুসুম গরম পানি আনতে বলে নিজে কোন রকম টান দিয়ে বের করেন বাচ্চা টাকে। অদ্ভুত সুন্দর সেই সন্তান টাকে কোলে নিয়ে হতভম্ভ হয়ে যান তিনি। বাচ্চা টা যেন ঘুমাচ্ছে।

এর মাঝে তোয়ালে নিয়ে সেই মহিলা আসলে তিনি তোয়ালে দিয়ে কোন রকম বাচ্চা টাকে মুছিয়ে দেন। তারপর খেয়াল করেন বাচ্চা টা কাঁদছে না। তিনি অনেক চেষ্টা করছেন। কিন্তু কোনভাবেই বাচ্চাটাকে কাঁদাতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত দেখলেন বাচ্চাটা মারা গেছে।

বাচ্চাটা মারা যাবার পর তিনি রাকিব সাহেবের দিকে খেয়াল দিলেন। এতক্ষন তিনি যেন ঘোরের মাঝে ছিলেন। মেডিক্যাল সায়েন্স কে বোকা বানিয়ে এই মাত্র এই লোকটা একটা বাচ্চা জন্ম দিল। কিন্তু বাচ্চাটাকে তিনি বাঁচাতে পারলেন না। আগে জানলে তিনি ঠিক ই রাকিব সাহেবের ব্যাবস্থা করতেন। তিনি তাড়াতাড়ি রাকিব সাহেব এর নার্ভ দেখলেন। কিন্তু হতাশ হলেন। তিনি ভেবেছিলেন রাকিব সাহেব অজ্ঞান হয়েছেন। আসলে তিনি মারা গেছেন সেই চিৎকার দিয়েই। এবার কিছু টা মুষড়ে পড়লেন তাহসিনা। তিনি লোকটাকে বিশ্বাস করলে দুইজন কেই হয়ত বাচানো যেত।

এরপর তাহসিনা সেই বাচ্চাটাকে গোপনে সরিয়ে ফেলার ব্যাবস্থা করেন। সেই বৃদ্ধা মহিলা কে দিয়েই বাচ্চাটাকে সেই বাড়ির এক কোনায় কবর দেবার ব্যাবস্থা করেন। আর রাকিব সাহেব কে কবর দেয়া হয় তার গ্রামের বাড়িতে। এই সব ব্যাপার ভাল মত সারতে সারতে উনার কয়েকদিন লেগে যায়।

এর তিন দিন পর রাতে ক্লান্ত ডঃ তাহসিনা মাত্র হাসপাতাল থেকে এসে বাসায় খেয়ে দেয়ে শুয়েছেন।এমন সময় উনার ঘরের বারান্দায় একটা আলতো টোকা দেয় কেউ একজন। তখন ও ঘুমান নি তাহসিনা। আস্তে করে ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঊঠে বারান্দার দরজা খুলেই দেখেন একটা বাচ্চা ছেলে দাড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে।মুখে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে আন্টি আন্টি বলে ঝাপিয়ে পরে তাহসিনার শরীরের সাথে মিশে যায়। ব্যাপারটা এতই তাড়াতাড়ি হয়েছে যে তাহসিনা বেশ কিছুক্ষন নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়লেন তিনি সেখানেই।

পরদিন জ্ঞান ফিরে নিজেকে মাটিতে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যান তিনি।তারপর রাতের ঘটনা কে নিছক স্বপ্ন ভেবে হেসে ঊড়িয়ে দিলেন তিনি। তারপর ফ্রেশ হবার জন্য বাথরুমে গেলেন। হাত মুখ ধুয়ে বের হতে যাবেন তখন পেটে চিনচিনে একটা ব্যাথা টের পেলেন। তাড়াতাড়ি নাইট গাঊনটা সরিয়ে পেটে হাত বুলালেন তিনি। এবং দিনের আলোতেই পরিষ্কার টের পেলেন তিনি – উনার পেটের যেখানে নাভি- ঠিক তার উপরেই একটা ফোঁড়া ঊঠেছে। লালচে ফোঁড়াটা দেখতে ঠিক রাকিব সাহেবের সেই ফোঁড়াটার মত। সাদৃশ্য টা টের পেতেই আবার জ্ঞান হারালেন সাইকিয়াট্রিষ্ট ডঃ তাহসিনা......

( সমাপ্ত )

/////////পৌনপুনিক ///// রহস্য-ফ্যান্টাসি গল্প

পৌনপুনিক ///// রহস্য-ফ্যান্টাসি গল্প (১৩-০৯-২০১১)


একা একা কম্পিউটারের সামনে বসে আছে নাহিদ। কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কাঁদছে সে। মেসে থাকে অনেকে মিলে- সবার সামনে থাকলে কাঁদতে পারেনা। তাই একা একা বাথরুমে গিয়ে কেঁদেছিল। কিন্তু কাঁদা শেষ হবার আগেই বাথরুমের দরজায় টোকা পড়ে- বের হয়ে আস্তে হয় ওকে। এখন ওর রুমে ওর দুই রুমমেট নেই- বাইরে গেছে সিগারেট খেতে। এই সুযোগে কেঁদে নিচ্ছে সে। এমন সময় রুপম এসে ঢুকল। নাহিদের ক্লাস মেট রুপম ওর সাথেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। কিন্তু বড়লোক বাবার ছেলে বলে নাহিদের মত অভাব নেই ওর। নাহিদ এখন খুব কষ্টে আছে। প্রাইভেট ইঊনিভারসিটি তে পড়ছে- অনেক টাকা প্রতি সেমিষ্টার ফি দিতে হয় ওকে। এই মাসেই চলতি সেমিষ্টার ফি দিতে হবে ওকে- এখন ও দিতে পারেনি। কিভাবে পারবে? ওর বাবা মারা গেছেন এক বছর হল। সরকারী চাকরি করতেন তিনি- চাকরির মাঝেই হার্ট এটাক করে মারা যান তিনি। তাই পেনশনের টাকা হাতে পায়নি নাহিদ। বাড়িতে মা আর বোন থাকে- পড়ালেখার খরচ চালান নাহিদের মা। উনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়ান। আর নাহিদ ও টিউশনি করে চালায়। কিন্তু এই মাসে হটাত করে দুইটা টিউশনি চলে যাউ নাহিদের। তিনটা টিউশনি র মাঝে যেটা বাকি ছিল সেটা তে যে টাকা পায় তাতে নিজের থাকার খরচ ই মেটাতে পারেনা। এখন কিভাবে সেমিষ্টার ফি দেবে সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কেঁদে ফেলল সে।

রুমে ঢুকেই রুপম বলল-

"দোস্ত- তুমি কি ঐ প্রকাশকের কাছে গেসিলা?"

প্রকাশকের কথা শুনে মন আরো খারাপ হয়ে গেল তার। গতমাসে ওর লেখা একটা গল্প সংকলন নিয়ে গিয়েছিল বাংলাবাজারে প্রভৃতি প্রকাশনের মালিক দিদার সাহেবের কাছে। উনি ঘোষনা দিয়েছিলেন যে একটা প্রতিযোগিতা হবে- সেখানে যে প্রথম হবে তাদের বিনামুল্যে বই বের করে দেয়া হবে একুশে বইমেলায়। নাহিদ ও পাঠিয়েছিল সেই প্রতিযোগিতায়। অনেক গল্প লিখেছে নাহিদ। কিন্তু প্রতিযোগিতার কথা শুনে সে গল্প গুলো নতুন করে লিখে একটা পান্ডুলিপি বানিয়ে পাঠিয়েছিল প্রভৃতি প্রকাশনীতে। সেখানে সে প্রথম হয়েছিল। কথা মত ওকে বই বের করে দিচ্ছে কিন্তু বই বের করা বাবদ ওর কাছে চাইছে দশহাজার টাকা। প্রতিযোগিতার শর্তে এটা লেখা ছিলনা। এমনিতেই ও অনেক গরীব। এর মাঝে ফ্রি তে বই বের করে দেবে চিন্তা করেই টেবিলের কোনায় পড়ে থাকা গল্প গুলো বই আকারে চেয়েছিল। সাথে দশ হাজার টাকা উপহার ও পাওয়ার যোগ ছিল। এখন সেটা বেমালুম অস্বীকার করছে প্রকাশনী প্রধান। তাই মন খারাপ করে বলল সে-

"হ্যাঁ গিয়েছিলাম। ঐ একই কথা বলল সে। কোন ভাবেই আমাকে দশ হাজার টাকা দেবে না। বলেছে টাকা আমাকে ই দিতে হবে এবং সেটা তিন দিনের ভেতর। না দিলে যে ২য় হয়েছে তাকেই বই বের করে দেয়া হবে। এজন্য তিন দিনের মাঝেই বই এর জন্য টাকা দিতে হবে। "

বলেই যেন মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল নাহিদের। ওকে সান্তনা দিল রুপম। কিন্তু সবাই ওকে সান্তনাই দিল- কেউ ওর বিপদে এগিয়ে আসল না। বাস্তবতা তার করুন চিত্র যেন নিজের চোখে খুটে খুটে দেখাচ্ছে নাহিদ কে। না খেয়েই শুয়ে পড়ল নাহিদ। রাতে না খেলে একটা মিল বেঁচে যাবে- সেই টাকা দিয়ে সেমিষ্টার ফি কিছুটা ও হলে দেয়া যাবে ভেবে পানি খেয়ে পেট ভর্তি করে শুয়ে পড়ল সে। সারাদিন দৌড়া দৌড়ী করে কাহিল ছিল শরীর। তাই শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে।

ঘড়িতে যখন ঠিক দুইটা- এমন সময় ওর মোবাইলে একটা ফোন আসল। ঘুমের মাঝে ফোনটা কোন ভাবে কেটে দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেল সে। ঘুমিয়ে থাকলে কারো ফোন রিসিভ করেনা সে। আজো করবেনা ভেবে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। একটু পর আবার রিং আসতেই আবার কেটে দিল। এবার মোটামুটি ঘুম ভেঙ্গে গেলে ও প্রাইভেট নাম্বার দেখে রিসিভ করেনি। রাতে বিরাতে জীনের বাদশা র মত কিছু ভন্ড মানূষ কে ফোন করে ভয় দেখায়। অনেক সময় সেই নাম্বার গুলো প্রাইভেট নাম্বার হয়। এটা ভেবেই ফোনটা ধরেনি সে।

একটু পরেই তৃতীয় বার রিং বাজতেই ফোনটা রিসিভ করল সে। করেই বললঃ

"হ্যালো "

ওপাশ থেকে কোন উত্তর আসছেনা দেখে আবার বললঃ

"হ্যালো- কে বলছেন?"

কোন উত্তর নেই। এবার ক্ষেপে গেল সে- চিৎকার করে বললঃ

" কে বলছেন? কথা বলছেন না কেন? ফোন করতে পারেন- কথা বলতে পারেন না?"

এবার কেমন যেন খর খর আওয়াজ শুরু হল মোবাইল থেকে। কেমন যেন অদ্ভুত রকম একটা আওয়াজ।আস্তে আস্তে আওয়াজ এর উচ্চতা বেড়েই চলেছে। অদ্ভুত রকম সাঁ সাঁ আওয়াজ করেতে শুরু করল ওর মোবাইল থেকে। শেষে বিরক্ত হয়ে যখন রেখে দিতে যাবে তখন যেন অনেক দূর থেকে একটা কন্ঠ বলে ঊঠল-

“হ্যালো”।

কন্ঠ টা শুনে হটাত করে শোয়া থেকে সটান বসে পড়ল সে। বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হয়ে গেল তার। এই কণ্ঠ আর কারো না- ওর মৃত বাবার। এই কন্ঠ কোন ভাবেই অন্য কারো হতে পারেনা। সে কণ্ঠ টা আবার শোনার জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। এবার মিনিট খানেক পরে আবার বলে ঊঠল-

-‘হ্যালো’

এবার আর দেরী করল না সে- কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ঊঠল-

-কে? বাবা?

বলেই কেঁদে ফেলল সে- বুক থেকে যেন বের হতে যাইছে এক বছরের জমে থাকা দুঃখ গুলো। কোনভাবেই নিজেকে থামাতে পারছেনা। মোবাইলেই কাঁদতে কাঁদতে বলল-

“বাবা সত্যিই কি তুমি বলছ বাবা? সত্যিই তুমি?”

বলেই উত্তরের অপেক্ষা শুরু করল-ওপাশ থেকে বলল-

-“হ্যাঁ রে- তুই ভাল আছিস তো? বাবু সোনা?”

বাম হাতে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল-

-“এইত বাবা আছি- কিন্তু তোমাকে অনেক অনেক মনে পড়ে বাবা।
অনেক... তুমি নেই- যেন আমার আসলেই কেউ নেই- তুমি ছাড়া কেউ আমার খেয়াল রাখেনা বাবা”- বলেই হাউমাঊ করে কেঁদে ফেলল আবার নাহিদ।

-“ হ্যাঁ রে কাদিস না- শোন আমি যে তোকে ফোন করেছি সেটা কাউকে বলিস না- আর আমি এখন যা যা বলব তুই সেটাই করবি- তাহলে তোর লেখা পড়া থেমে যাবেনা- তুই আবার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবি”

-ওপাশ থেকে বলল নাহিদের বাবা।

-“ বাবা তুমি যা যা বলবে আমি তা তা করব বাবা শুধু তুমি একবার বল- কি করতে হবে আমাকে ? -কেঁদে কেদেই বলে চলল নাহিদ।

“শোন – তুই যেখানে লেখা দিয়েছিস- সেটার পেছনে একটা দোকান আছে- সেখানে এক বৃদ্ধ লোক বসে- উনাকে তোর লেখা টা কালকেই দেখাবি। উনি তোর লেখা ছাপিয়ে দেবেন। তোকে উনি কালকেই দশ হাজার টাকা ও দেবেন । সেই টাকা দিয়ে তুই তোর সেমিষ্টার ফি দিবি- কি পারবিনা?” অপাশ থেকে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিমা।

“ কিন্তু উনি কি আমার লেখা ছাপাবেন?” নাহিদের কন্ঠে বিস্ময়।

“উনি তোর মত একজন কে খুঁজছে। কাল ঠিক বেলা ১১টায় উনার কাছে একজন লোক আসার কথা। কালকে খিলগাঁও এলাকায় ফ্লাইওভার এ ফাটল দেখা দেবে। সেই জন্য বিশাল জ্যামে পড়বে সেই লোক। তুই এই ফাঁকে আগে থেকে চলে যাবি বাংলাবাজার। ঠিক এগারোটায় সেখানে গিয়ে দেখা করবি বৃদ্ধের সাথে। এরপর তোকে আর টাকা নিয়ে ভাবতে হবেনা। আমি এখন রাখি রে- ভাল থাকিস- সব সময় তোর মায়ের দিকে খেয়াল রাখবি। রানু কে ভালমত মানুষ করবি। রাখি” – বলেই খট করে ফোন রেখে দিল ওপাশ থেকে।

কিছু ক্ষন জেগে জেগে ভাবল নাহিদ। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে।
পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ই প্রথমে ফটোকপি র দোকান এ গিয়ে দোকানদার কে ঘুম থেকে জাগিয়ে লেখা গুলোর কপি করে নিল। তারপর পান্ডুলিপি বানিয়ে রওনা দিল বাংলা বাজারের দিকে। সেখানে প্রভৃতি প্রকাশনের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করল কিছুক্ষন। তারপর সময় কাটেনা দেখে রাস্তায় এসে কিছু ক্ষন হাটাহাটি করল। একে একে দশটায় সব দোকন খুলে গেল। সে প্রভৃতি প্রকাশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল- এমন সময় প্রভৃতি প্রকাশনের পাশের দোকান খুলে ঢুকল এক আশি ছুই ছুই বৃদ্ধ। উনার প্রকাশনীর নাম “আদিত্য প্রকাশন”।

এগারোটা বাজতেই আস্তে করে দরজা দিয়ে ঢুকে বৃদ্ধের দিকে পান্ডুলিপি এগিয়ে দিল নাহিদ। বৃদ্ধ যেন আগে থেকে ই জানত সে আসবে। কিছুক্ষন কিছু পৃষ্টা উলটে পালটে দেখে বৃদ্ধ ওকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল। তারপর কাগজ কলম এগিয়ে দিল। সে পড়ে দেখল একটা ২০০ টাকার স্টাম্প। সেখানে অনেক অনেক কথা লেখা। সে আস্তে আস্তে পড়ে তারপর সাক্ষর দিয়ে বের হয়ে আসল সেখান থেকে। সে বের হয়ে আসতেই একজন লোক দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বৃদ্ধের কাছে আসল। ঐ লোক কে দেখেই নাহিদ ঐ খান থেকে চলে আসল তাড়াহুড়া করে।

এই ব্যাপার টা নিয়ে সেই আদিত্য প্রকাশনী থেকে খানিকটা সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত নাহিদের বই বই মেলায় বের হল এবং চারদিকে ওর সুনাম ছড়িয়ে পড়ল।যেন এক ঝটকায় ভাগ্য লক্ষ্মী ওকে খুলে দিল এক অবারিত সম্ভাবনার দ্বার।
.........................................................


ঠিক ৩৫ বছর পর
প্রখ্যাত লেখক নাহিদ হাসান উনার পঞ্চম সিনেমার পরিচালনা থেকে ফিরে মাত্র বাসায় এসে বসেছেন। রাত বাজে দুইটা। উনি ইদানিন অনেক বেশী ব্যাস্ত। ডিজিটাল মিডিয়াতে উনার বর্তমান সিনেমা “জীবনের গল্প” যেটা উনার নিজের জীবন নিয়েই বানাচ্ছেন সেটা নিয়ে ব্যাপক প্রচারনা হয়েছে। ফলে উনি কাটাচ্ছেন অনেক কর্ম ব্যাস্ত দিন। আশা করছেন এই সিনেমা অস্কারে মনোনিত হবে। গতবছর একটুর জন্য অস্কার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল একটা মালেশিয়ান সিনেমার জন্য। এবার উনাকে কেউ হারাতে পারবেনা- চিন্তা করতে করতে খানিকটা ঘুমিয়েছেন- এমন সময় উনার মোবাইলে একটা ফোন আসল। উনি ফোন ধরেই বললেন-

“ নাহিদ হাসান বলছি- কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষন খস খস আওয়াজ করার পর কে যেন বলে ঊঠল-

“ কেমন আছো নাহিদ?”

গলাটা শুনেই ৩৫ বছর পর আবার চমকে ঊঠলেন তিনি। মনে পড়ে গেল ঊনার বাবার কথা। সেই ৩৫ বছর আগে তিনি ফোন করেছিলেন। তারপর এতদিন পর তিনি আবার ফোন করলেন। আস্তে আস্তে অপাশ থেকে বলে ঊঠলেন-

“নাহিদ- কেমন আছো? আশা করি- ভাল আছ- শুনো- একটু পর আমি তোমাকে একটা লাইন দেব- সেখানে কে আছে জানার দরকার নেই- শুধু তুমি কথা বলবে”- বলেই থামলেন কেউ ওপাশ থেকে।

“কার সাথে কথা বলব আমি বাবা?” নাহিদ সাহেবের কন্ঠে সেই বিস্ময়।

“ তোমার জানার দরকার নেই। শুধু তুমি জেনে রাখ তূমি যা যা বলবে সব তোমার স্মৃটি থেকে। আজ থেকে ৩৫ বছর আগে রাতে তুমি ফোনে যা যা শুনেছিলে তাই তাই বলবে- একটা কথা ও বেশী বলবে না। একটা অক্ষর ও বেশী বা কম বলবে না। আমি এখন তোমাকে লাইনে দিচ্ছি”—বলেই খুট করে শব্দ হল একটা।

নাহিদ সাহেব হাঁ করে তাকিয়ে আছেন- এ রকম কিছু একটা হবে তিনি জীবনে ও ভাবতে পারেন নি। কেউ একজন উনাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কোথায় কিভাবে গিয়ে লেখা জমা দিতে হবে। এখন উনাকে এই কথা টা আরেক জনকে বলতে হবে- ভেবেই গলাটা শুকিয়ে গেল। ফোন কানে রেখেই এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেলেন তিনি। তারপর আবার ফোনে মনযোগ দিলেন তিনি। অপাশ থেকে শুধু খর খর শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষন খর খর শব্দের পর চিনচিনে একটা শব্দ শুরু হল। তিনি বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দেবেন এমন সময় ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে ঊঠল –

“হ্যালো”

কণ্ঠটা শুনেই বুকটা ধরাস করে ঊঠল উনার। গলাটা শুকিয়ে গেল এক নিমিশেই। কারন এই কন্ঠ তিনি খুব ভাল করে চিনেন।উনার কোন রকম ভুল হচ্ছেনা। ভুল হবার কথা ও না। ওপাশ থেকে যে ফোন ধরেছে সে আর কেউ নয়- ৩৫ বছর আগের সেই নাহিদ হাসান- এখন কার বিখ্যাত নাহিদ হাসান নিজে ...

(সমাপ্ত)

////////প্রতিশোধ /////////// ছোট গল্প

প্রতিশোধ...........৩০/০৮/২০১১

ঐ তো দেখা যাচ্ছে লালচে গোলাকার গহবর টা।দুই পাশ থেকে নেমে এসেছে কালচে কেশর। ভেতর থেকে ও নেমে এসেছে একটা- সুক্ষ্ম ও চিকন চিকন কেশর। মাঝ থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওটা। ঠিক আমার দিকে।আমার আজকে এখানে আসার পেছনে এত কষ্টের মুলে ঐ চলমান পাহাড়টা। ত্রিশ প্রহর আগে এই পাহাড়টা আমার সন্তান কে- আমার প্রাণের টুকরা কে মেরে ফেলেছে। হত্যা করেছে চরম নৃশংস ভাবে। আমি ভাবতে ও পারিনা- এভাবে আমার রক্ত কে ওটা মেরে ফেলতে পারে। আমার সন্তান না হয় খেলতে খেলতে চলমান পাহাড় টার এলাকায় চলে এসেছিল- হয়ত বা ভুল করে চলে এসেছিল ওর ঘুমানোর স্থানে- তাই বলে কি এভাবে চ্যাপ্টা করে পিষে ফেলতে হবে? আমার মাকে ও এভাবেই এক চলমান বিশাল পাহাড় পিষে হত্যা করেছিল। আমার বয়স তখন মাত্র দুই শত প্রহর। সেই ছোট্ট বয়েস থেকে আমি মা হারা। মায়ের আদর কি আমি বুঝিনি। আদর করে আমাকে বুলিয়ে দেয়নি ভালবাসা কেউ। আমি ষোল জোড়া পা নীলাভ থালার দিকে উঁচু করে উপরে তাকিয়ে সেখানে থাকা মহান প্রভুর কাছে কত চেয়েছি আমার মাকে ফেরত পেতে- মায়ের একটু ভালবাসা পেতে- কিন্তু পাইনি। আমার বাবা আর ভাইয়েরা আমাকে কত সান্তনা দিয়েছে। এনে দিয়েছে সবুজাভ গাছের পাতা। আমি খাইনি-মাকে ফেলে আমি খেতে ও পারিনি অনেক অনেক প্রহর। সেই থেকে আমি কতদিন অপেক্ষায় থেকে থেকে যখন বড় হয়েছি তখন বুঝলাম সেই নীলাভ থালার উপর বসে থাকা মহান প্রভু আমাদের সবাইকে মৃত্যু দিয়েছেন। মরার পর কেউ জীবিত হয়না। তাই আমি আমার একমাত্র সন্তান কে আগলে আগলে রাখতাম। কিন্তু সেই কুপ্রহরে কি যে হল- আমার বাবু সোনা হটাত করে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে চলে গেল ঐ দৈত্যের সামনে পড়ে গেল সে- আহ আর মনে করতে পারছিনা। কি যে দুঃসহ সেই স্মৃতি। ভাবতেই বুক ভেঙ্গে যায়। শয়তান টা আমার সন্তানকে চ্যাপ্টা করেই ক্ষান্ত হয়নি।একটা পাতলা সাদা বস্তু দিয়ে আবৃত করে আমার সন্তানকে ছুড়ে ফেলল অনেক নিচে বহমান তরলের ধারায়। সেই তরলের ধারা আমার সন্তানকে বয়ে নিয়ে গেছে বহুদুর। আমি অনেক খুজেছি আমার বাবু সোনার শেষ চিহ্ন টূকু- পাইনি। পাইনি আমার সোনা মানিক কে শেষ বারের মত দেখতে। তাই আমি অনেক ভেবে চিনতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি ঐ দৈত্যটাকে শেষ করে দেব। ওর ভেতর প্রসব করব আমার অনাগত সন্তান। ওর শরীরের ভেতর তৈরি করব নিষ্ঠুর মৃত্যুর জাল।

এখানে আস্তে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। প্রথমে সবুজাভ গাছের পাতা থেকে নেমে আমি আসলাম কালচে জলধারার তীরে। সেখানে আবার অনেক অনেক দৈত্য ছুটা ছুটি করে। লাঠি দিয়ে নির্দয় ভাবে পেটায় এক অবুঝ গোলাকার বস্তু। তারপর ছুটা ছুটি করে সেই লাঠিকে মাটিতে ঠেকিয়ে। ওদের পার হয়ে আসতে আমার অনেক বেগ পেতে হল। তারপর শরীর বেকিয়ে একটা সাদা আবর্জনা উপর পাড়ি দিয়ে চলে আসি সেই কালচে জলধারা। তারপর শুরু হয় আমার ক্লান্তি কর ভ্রমন। অনেক গুলো তলা পার করে আস্তে আস্তে যখন আমি এলাম তখন গরম প্রদিপ চলে গেছে নীলচে থালার উল্টো পাশে। এখানে আলো আছে বলে আমি ঠিক খুঁজে খুঁজে চলে এলাম সেই দৈত্যের কাছে।

ঐ যে সামনে পড়ে আছে দৈত্য। যেন খুব ক্লান্ত। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার নিখাদ শয়তানি। জানি এটাকে ওদের ভাষায় বলে ঘুম। আমি আসছি রে শয়তান। তোকে আমি জনমের ঘুম পাড়িয়ে দেব। এমন ভাবে তোর ভেতর বিষ ঢেলে দেব যে তুই কাঁদবি- কিন্তু ব্যাথায় ঘুমাতে পারবিনা।

দেখ আমি এসে গেছি- একদম কাছে এসে গেছি। ঐ গহবর টা দিয়ে ই আমি ঢুকবো। একবার ঢুকলেই বুঝবি যন্ত্রনা কি... মৃত্যু কি......

.........................
........................

দুই মাস পরঃ

ডাঃ রাজেশ মাত্র পোষ্ট মডেম করতে ঢুকলেন ওটি রুমে। প্রখ্যাত ব্যাবসায়ি আসাদ উল্লাহ্‌র একমাত্র ছেলে রাসিদ ঊল্লাহ মারা গেছে এক দম ছোট বয়সে। মৃত্যুর আগে ওর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। অনেক লোক এটাকে সাধারন মৃত্যু বললে ও আসাদ উল্লাহ্‌র ভাষায় এটা হত্যা। উনার সম্পত্তির লোভে ঊনার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করেছে উনার ভাই এই এজাহার দিয়ে পুলিশে দিয়েছেন উনার ভাই কে। আর পুলিশের আদেশে কবর না দিয়ে লাশ পোস্টমর্টেম টেবিলে নিয়ে আসা হয়েছে।

ডাঃ রাজেশ আস্তে আস্তে বুকের কাছ থেকে কাটতে শুরু করলেন লাশ। একটা বাচ্চা ছেলেকে কাটতে উনার খারাপ লাগছে। স্কাল্পেল দিয়ে কাটতে কাটতে এক যায়গায় এসে উনার চোখ থেমে গেল মাংসের ভাঁজে একটা পিন্ডের ঊপর এসে। ভাল মত দেখেই বুঝলেন এটা একটা লার্ভা। কিন্তু এটা কিভাবে এখানে এসেছে বুঝতে পারলেন না তিনি।

প্রথমে লিভারটা কেটে সেটার ভেতর নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝলেন যে ছেলেটাকে কোন বিষ দেয়া হয়নি। তারপর একই ভাবে একটা একটা অঙ্গ পরীক্ষা চালিয়ে যেতে থাকলেন তিনি।কেটে কেটে পরীক্ষা করতে করতে মাথার খুলি থেকে চুলের আস্তরণ কেটে খুলির উপরিভাগ তুলে ফেলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ডাঃ রাজেশ। কানের ভেতর থেকে শুরু করে পুরো মস্তিষ্ক আর খুলির কোটরে কোটরে সব জ্যান্ত বিছা। পিল পিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব। যেন নিজেদের আস্তানা। রক্তাক্ত কিছু বিছা দেখেই বুঝলেন এই বিছা গুলো কোন এক অজানা কারনে রক্ত লোলুপ হয়ে প্রবেশ করেছে এই ছেলেটার কানের ফুটো দিয়ে।তারপর বংশ বৃদ্ধি করে বাড়িয়েছে নিজেদের। যদি ও বিছা প্রাণী টা নিরামিষ ভোজী- কিন্তু এখানকার বিছা গুলো রক্ত পান করতে দেখেই বুঝলেন যে এই বিছা গুলো ছেলেটার মস্তিষ্কের বেশ কিছু সেল ও খেয়ে ফেলেছে।

ভাবতে ভাবতে পোষ্টমরটেম রিপোর্টে কথা গুলো লিখতে লাগলেন ডাঃ রাজেন। কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি- কখন একটা রক্তলোলুপ বিছা উনার আপ্রনের ভেতর করে চলে এসেছে উনার শরীরে। যেকোন সময় সেটা প্রবেশ করবে ডাঃ এর শরীরে- আরেকটা সুস্বাদু গরম রক্তবাহী প্রানীর তরল রক্তের খোঁজে ......

///////////আজরাইল ////////// রহস্য- রোমাঞ্চ-ভৌতিক গল্প

আজরাইল ///// ২২-০৯-২০১১



ঘটনার শুরু আজ থেকে চার বছর আগে এক রাতে। আমি সিলেট এর ওসমানী মেডিকেল এ একটা সেমিনার শেষ করে নিজেই ড্রাইভ করে ফিরছিলাম ঢাকায়। সাধারণত আমার পাজেরো টা আমার খুব প্রিয় হওয়াতে আমি কাউকে ড্রাইভার রাখিনি। সেদিন ও আমি নিজেই চালিয়ে নিয়ে আসছিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। পথে খানিক টা ঘুম ঘুম ভাব আসলেও মন টা সতেজ ছিল- কারন সেই সেমিনারে আমি আমার গবেষনার জন্য পেয়েছি প্রচুর হাততালি। সাংবাদিক রা ফটাফট ছবি তুলে নিয়েছিল আমার। পরদিন পত্রিকায় আমার ছবি সহ লিড নিউজ ও হবার কথা ই ছিল এবং হয়েছিল ও তাই। আমি একটা বিশেষ হার্ট সার্জারি আবিষ্কার করেছিলাম- যেটা আজ পৃথিবীর সব দেশে দেশে রোগীদের জীবন বাঁচাচ্ছে- মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে নতুন জীবনের।সেমিনারের সফলতা তাই জুড়ে ছিল আমার মনে প্রানে।


রাস্তায় যেতে যেতে সেদিন আমি গান শুনছিলাম। গানের তালে তালে ধীর গতিতে গাড়ি চালাই আমি। বেশি গতি আমি কখনোই তুলিনা।সেদিন ও ৫০ এর কাছাকাছি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। সিলেট থেকে রওনা দিয়ে উজানভাটি এলাকার কাছাকাছি আসতেই হটাত করে আমার সামনে এক সাদা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ লোক এসে দাঁড়ায়। রাত তখন প্রায় দুইটা। এই সময় রাস্তায় হাইওয়ের গাড়ি গুলো ছাড়া কোন যানবাহন ও ছিলনা। হটাত করে আমার সামনে কোত্থেকে লোকটা এসে পড়ল কিছু বুঝে ওঠার আগেই। আমি ও লোকটাকে বাঁচাতে গিয়ে ও পারলাম না। সোজা সেই লোকের ঊপর চালাতে বাধ্য হলাম। আর সেখানেই গাড়ির সামনের অংশে বাড়ি খেয়ে লোকটা ছিটকে পড়ল হাত পাঁচেক দূরে। আমি হার্ড ব্রেক কষে সেইবৃদ্ধের কাছে ছুটে গেলাম। কিন্তু ততক্ষনে সব শেষ। মাথার কাছটায় আঘাতে মৃত্যু বরন করেছে বৃদ্ধ ততক্ষনে। জীবনে ও আমি কোন দিন এক্সিডেন্ট করিনি।সেটাই ছিল আমার প্রথম এক্সিডেন্ট। আমি দিশেহারা হয়ে যাই। কিভাবে কি করব বুঝে ঊঠতে না পেরে কিছুক্ষন ঝিম মেরে থাকলাম সেখানেই। তারপর বৃদ্ধকে গাড়িতে তুললাম। পাশে বসিয়ে আবার ড্রাইভ করলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।


ঢাকায় পৌছে সোজা মেডিক্যাল এ নিয়ে গেলাম লাশ টাকে। সেখানে গিয়েই পুলিশ কে জানানো হল। পুলিশ এসে আমার কাছ থেকে জবানবন্ধি নিয়ে লাশ টা থানায় নিয়ে গেল। আমি প্রথমে ঠিক করেছিলাম পুলিশ কে সব খুলে বলব। কিন্তু পরে কি ভেবে যেন আমি মিথ্যে বলি। পুলিশ ও আমার কথা গুলো কোন রকম সন্দেহ ছাড়াই বিশ্বাস করে। নিজের কাছে আমি কিছু টা অপরাধী বোধ করলে ও নিজের ইমেজ বাঁচাতে এই মিথ্যেটা আমাকে বলতেই হয়েছে।


তারপর কেটে গেছে অনেক গুলো মাস। আমি আমার আবিষ্কৃত প্যারা সার্জারি সিস্টেম এর জন্য অনেক গুলো পুরষ্কার ও পাই। খ্যাতি আর অর্থ দুটোই এসে ধরা দেয় আমাকে। ধীরে ধীরে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে চলে আমার। নিজেকে কিছুটা ঈশ্বরের সমপর্যায়ের ভাবতে থাকি। এরজন্য মিডিয়া ও কম দায়ী নয়।খবরের পাতায় কারো না কারো জীবন বাঁচানোর জন্য আমি ঊঠে আসতে থাকি নিয়মিত ভাবে। ধীরে ধীরে আমি অনেক অনেক বেশী অহংকারী হয়ে ঊঠি। কাউকেই পরোয়া না করার একটা ভাব চলে আসে আমার মাঝে। মানুষ কে আমি মনে করতে শুরু করি হাতের পুতুল। আমি চাইলেই যেকোন মৃত্যু পথযাত্রীর জীবন বাচিয়ে দিতে পারতাম। এই জন্য আমার কাছেই ছুটে আসতে লাগল হাজারো মানুষ। এই যশ আর খ্যাতি যখন তুঙ্গে তখন আমার কাছেই রুগী হয়ে আসেন বাংলাদেশের প্রথিত যশা রাজনীতিবিদ রেজোয়ানুল হক। আমি বাকি সবার মত উনাকেও আস্বস্থ করেছিলাম যে উনার কিছু ই হবেনা।


যেদিন উনার অপারেশন – সেদিন আমি আরো দুটি হার্ট অপারেশন করে ফেলেছিলাম। তাই কিছু টা ক্লান্তি ছিল। একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপারেশন গুলো করতে হয়। তাই ক্লান্তি ভর করে সহজেই। আমি ক্লান্ত থাকলে ও মনে মনে পুলকিত ছিলাম কারন এর পরেই আমি রেজোয়ানুল হকের অপারেশন করবো। উনাকে যখন অজ্ঞান করা হল তখন আমি নিজের কস্টিউম পড়ছি। জুনিয়র ডাক্তার কে দিয়েই এগুলো করাই আমি। আমি শুধু গিয়ে কাটাকাটির কাজ টা করি। সেদিন ও জুনিয়র তিনজন ডাক্তার মিলে সব প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা সেরে আমাকে কল দিল। আমি ও গেলাম। আর গিয়েই শুরু করলাম অপারেশন। ওপেন হার্ট সার্জারি ছিল সেটা। আমি যখন সব কেটে কুটে মাত্র হার্ট টাকে দেখতে লাগলাম এমন সময় আমার চোখ গেল ওটি রুমের বাম কোনায়। সেখানে আমার দিকে তাকিয়ে বসে আছে সেই বৃদ্ধ। আমি দেখে চোখের পলক ফেলতেই দেখি উনি নেই। হ্যালুসিনেশন মনে করে আবার অপারেশন শুরু করলাম। রেজোয়ানুল হকের হার্ট এর নিলয় এর দুটো শিরায় চর্বি জমেছিল। আমি সেগুলো পরিষ্কার করতে করতে হটাত করে কানের কাছে একটা কাশির শব্দ শুনলাম। প্রথমে পাত্তা দিলাম না। কারন এইখানে কোন ভুল হলেই রোগী মারা যাবেন। আমার কোন রকম ভুলের কারনে এতবড় মানুষ টার মৃত্যু হবে ভেবে আমি আবার মনযোগ দিলাম। কিন্তু আবার কাশির শব্দ আসল। কাশিটা আসছিল বাম দিক থেকে। আমি বামে মাথা ঘুরিয়ে দেখি বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ঠোট নাড়ার আগেই বলে ঊঠল –

“বাবাজি তুমি তো উনাকে বাঁচাতে পারবানা”

আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি আকাশ পাতাল চিন্তা করে চলেছি। একজন মৃত মানুষ কিভাবে আমার পাশে এসে দাড়াতে পারে সেটাই মাথায় আসছিল না। আমি কোন উত্তর দেবার আগেই সেই লোকটি বলল-
“ কি বুঝতে পারছো নাতো? শোনো- আমি জানি তুমি অনেক চেষ্টা করবে উনাকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু পারবেনা”- বলেই আবার হেসে দিল সাদা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ।


আমি বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। কি বলব বুঝতে পারছিনা। উনাকে কি বলবো বুঝতে বুঝতে কাটিয়ে দিলাম পাঁচ সেকেন্ড। তারপর আবার মনযোগ দিলাম অপারেশনে। রোগীর অপারেশন সাকসেস হল। আমি ও হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। সেলাই করে দিয়ে শেষ বার ড্রেস করতে দিয়ে আমি মাস্ক খুলতে যাব এমন সময় হটাত করে রোগীর পালস রেট গেল বেড়ে। মেশিন গুলো যেন চিৎকার শুরু করে দিয়েছে।


হটাত করে বুকের ভেতর ধপধপ করা শুরু করল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে রোগীর প্রেশার দেখলাম- বেড়েই চলেছে প্রেশার। হটাত করে এই অবস্থা হবার কথা না। আমি কয়েকজন ডাক্তারকে বললাম প্রেশারের ইনজেকশন দিতে। ওরা সেটা দিতেই প্রেশার ডাউন হওয়া শুরু করল। কিন্তু আবার ও বিপত্তি। এবার প্রেশার কমতে লাগল। আমি আবার টেনশনে পড়ে গেলাম। কিন্তু কোনভাবেই কিছু করতে পারলাম না। রোগীর হার্ট বিট ভয়ানক ভাবে কমতে কমতে একেবারে শুন্য হয়ে গেল নিমিশে। এবং আমি তাকিয়ে তাকিয়ে রেজোয়ানুল হকের মরে যাওয়া দেখলাম। প্রথম বার আমার সামনে এক রোগী বলে কয়ে মরে গেল- আমি কিছুই করতে পারলাম না।


আমি আমার রুমে এসে বসে পড়লাম। রাগে আমার গা জ্বলতে শুরু করল। নিজেকে অনেক অসহায় মনে হতে লাগল। পরদিন বিভিন্ন পত্রিকায় রেজোয়ানুল হকের পাশাপাশি আমার হতাশাগ্রস্থ মুখ ও প্রকাশিত হল। মিডিয়া এমন এক জিনিস- কাঊকে মাথায় তুলতে দেরী করেনা- কাউকে মাটিতে আছাড় মারতে ও দেরী করেনা। আমাকে ও মাটিতে নামিয়ে আনল ওরা। আমার বিরূদ্ধে হত্যা মামলা রজু করা হল সেই নেতার দলের লোকজনের পক্ষ থেকে। কিন্তু সরকার আমার পাশে ছিল বলে মামলা ধোপে টেকেনি। টাকা পয়সা খাইয়ে পুলিশ আর আদালতের সবকটাকে কিনে নিয়েছিলাম।


তারপর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। আমি ও ফিরে আসি বাস্তব জীবনে। রোগীদের সেবায় মনযোগ দেই। ছোটখাট অপারেশন এ যোগ যেই। এরপর আসতে আসতে আমার জীবন স্বাভাবিক হয়ে ঊঠে।
কিন্তু এর ঠিক ছয় মাস পড়েই এই মহিলা ডাক্তার কে অপারেশনের দায়িত্ব পরে আমার উপর। আমি নিরুপায় ছিলাম। উনাকে আমি কর্মজীবনে শ্রদ্ধা করতাম। আমার শিক্ষিকা ছিলেন। উনার হার্টে ব্লক ধরা পড়াতে উনাকে অপারেশনের দায়িত্ব উনি নিজেই আমাকে দেন। খুব ছোট অপারেশন। হরহামেশাই এই ধরনের অপারেশন হত-এখন ও হয়। হার্টের যে ধমনী গুলো ব্লক হয়ে যায় সেগুলোতে রিং পড়ানোর কাজ। আমি প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু রোগীর পীড়াপীড়ি তে রাজি হই।


অপারেশন টেবিলের সামনে এসেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। কারন সেখানে সেই দিনের মতই বাম কোনায় বসে ছিল সেই বৃদ্ধ। উনাকে দেখেই বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠে আমার। অজানা আশংকায় কেঁপে উঠে মন।


কিন্তু বাধ্য হয়ে আমাকে অপারেশন করতে হয়। আমি ও শুরু করি। হার্টের ধমনী একটাতে রিং পড়ানো শেষ করে আরেকটা যখন ধরবো এমন সময় কানের কাছে ফিসফিস করে বৃদ্ধ সেই আগের মতই বলল-

“বাবাজি- আজকা ও তুমি উনারে বাচাতি পারবানা”

হাসি হাসি মুখের ভেতর যেন রাজ্যের ঘৃণা। আমি উনার চেহারার দিকে এক পলক তাকিয়েই আবার কাজ শুরু করলাম। কিন্তু রিং পড়াতে গিয়েই হটাত করে ভুল করে কেটে গেল ধমনী টা। গলগল করে রক্ত বের হতে শুরু করল। নিরুপায় হয়ে তিন চার জন মিলে সেই রক্ত বন্ধ করে ধমনী পরিষ্কার করে জোড়া লাগাতে বসল। আমি নিজেও হাত দিলাম। কিন্তু যা হবার তাই হল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়ে রোগীর অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেল। আমি রক্তের জন্য লোক পাঠালাম। কিন্তু সামান্য ও পজেটিভ রক্ত সেখানে ছিলনা। এতবড় একটা হাসপাতালে ও পজেটিভ রক্ত না পেয়ে সেই ডাক্তার আপা মারা গেলেন চোখের সামনে। আমার কিছু ই করার ছিলনা।


এরপর একদম ভেঙ্গে পড়েছিলাম আমি। আমার পরিবার থেকে বিয়ে করার জন্য চাপ আসল। আমি ও বিয়ে করলাম। মিতি- আমার বৌ- লক্ষ্মী বৌ আমার। যাকে বলে একেবারেই আটপৌরে মেয়ে। বিয়ে হয়েছে আমাদের মাত্র তিন সপ্তাহ। এরমাঝেই আমাকে করেছে আপন। কিন্তু ভাগ্য সহায় না থাকলে যা হয়- বিয়ের তিন সপ্তাহের মাথায় ওর আব্দার রাখতে গেলাম কক্সবাজার এ। সেখানে প্রথম দিনেই একটা আছাড় খেল মিতি বাথরুমে। প্রথমে আমি তেমন কিছু না বলে পাত্তা না দিলে ও পরে বুঝতে পারি মিতির কোন একটা বিশেষ সমস্যা হয়েছে।


তখনই আমি মিতিকে নিয়ে আসি ঢাকায়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানতে পারি মিতির মাথায় রক্তক্ষরণ হয়েছে আছাড়ের ফলে। খুব দ্রুত মিতিকে অপারেশন করাতে হবে। নিজের স্ত্রী বলে মিতির অপারেশন আমি করতে চাইনি। কিন্তু সেই মুহূর্তে সব ভাল ভাল সার্জন রা দেশের বাইরে থাকাতে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হল। আমি ও মেনে নিলাম অর্পিত দায়িত্ব।


আমি এখন বসে আছি মিতির রুমের সামনে। আরেকটু পর মিতির অপারেশন। আমি মিতির দিকেই তাকিয়ে ছিলাম- কিন্তু হটাত করে চোখ গেল মিলির কেবিনের বাম কোনায়। সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে সেই বৃদ্ধ। জানিনা কি হবে আজকে। যে কোন ভাবে মিতিকে বাঁচাতেই হবে। কিন্তু আজরাইলের বেশে বৃদ্ধের মুচকি হাসি দেখে আমার আশার প্রদিপ নিভতে শুরু করে দিয়েছে……



(সমাপ্ত)

ছোট গল্প...███ লাশ ███ ................... ২৮/০৭/২০১১

২১-০৩-১৯৯৭
ফিরোজকে আমি বিশ্বাস করে ভুল করেছি। ওকে আমি ভুল করে খুব ভাল একজন বন্ধু মনে করেছিলাম। তাই ওকে দিয়েছিলাম আমার ভাইয়ের স্থান। আমার মাকে মা বোন কে বোন ডাকার অধিকার। ছোটবেলা থেকে ওকে আমি নিজের ভাইয়ের মত দেখেছি। কিন্তু আজ আমার কাছে সব পরিষ্কার। ও আমার ভাই নয়- ও আমার বোনার ঈজ্জত হরণ করেছে একা পেয়ে। যে বোন হেসে খেলে কাটাত ওর সময়- সে এখন কবরের ভেতর। আত্মহত্যা ছাড়া হয়ত কোন পথ খুঁজে পায়নি।

কদিন আগে সুমি আমাকে বলেছিল-
"ভাইয়া ফিরোজ ভাই আমার দিকে কেমন কেমন করে তাকায়- আমার ভাল লাগেনা"
সেদিন আমি ওকে আদর করে বলেছিলাম -
"বোকা তোকে তো ও নিজের বোনের মত দেখে।"
আমি বিশ্বাস করিনি সেই ফিরোজ যাকে আমি নিজের ভাই মনে করেছিলাম সে রাস্তা থেকে সুমিকে তুলে নিয়ে গিয়ে......
না।। আর ভাবতে পারছিনা। ওকে আমি খুন করে ফেলবো..

২৭-০৩-১৯৯৭

মাত্র আমি ফিরোজকে লোহার রড দিয়ে মেরে মাথার পেছন দিকটা থেতলে দিয়েছি। এক বাড়িতেই শেষ বেচারা। ইচ্ছা ছিল ওকে কেটে টুকরা টুকরা করে ভাসিয়ে দেব বুড়িগঙ্গায়- কিন্তু এখন ঘেন্না লাগছে। এইত কদিন আগেও কোরবানির গোস্ত কাটার জন্য আমাকে ও হাত লাগাতে হত। নিজের হাতে কত মাংস কেটেছি। কিন্তু এই পশুটার দিকে তাকাতেই আমার খুব ঘেন্না হচ্ছে।

কি করা যায় একে? বস্তা ভরে নিয়ে গিয়ে ফেলে দেব নদীতে?
নাহ- ভুল হবে। কালকেই লাশ ভেসে ঊঠবে- তখন আমাকে ঠিক বের করে ফেলবে পুলিশ।
কাটাকাটির চিন্তা তো আগেই বাদ দিয়েছি।
মাটি চাপা ও দিতে পারতাম- কিন্তু এখন ঢাকা শহরে খালি যায়গা খুঁজেই পাওয়া যায়না। মাটি চাপা দেব কই? এর মাঝেই লাশের গা থেকে গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়েছে। মাকে তিনদিন আগে রেখে এসেছিলাম আমার ফুফুর বাড়িতে। না হলে এখন মা এসব দেখলে ঠিক পাগল হয়ে যেতেন।
কি করি এখন?

২৮-০৩-১৯৯৭
টানা দুই দিন হতে চলল আমি কিছু খাইনি। লাশটাকে রেখেছি বাথরুমে ।
একটু আগে দুইবার বমি হয়েছে আমার। ফুফুর বাড়ি থেকে মা ফোন করেছিল। এখানে আসতে চায়। কিন্তু এখন এখানে আসলে আরেক কান্ড বাধবে। তাই এখন আসতে না করে দিয়েছি।
এখন অনেক রাত। এত রাতে শুধু একটা বাড়িতেই আলো জ্বলে। সেটা হল এলাকার নেতা সংসদ সদস্যের বাড়িতে। উনি সারা রাত জেগে দিনে ঘুমান। ভোটের সময় দেখা হয়। তারপর উনি হাপিস হয়ে সারা বছর ঘুমান। এভাবেই চলছে। আমি কি উনার কাছে যাব? গিয়ে বলব যে আমি একটা খুন করেছি?
পুলিশকে ফোন করেছিলাম। বিশ্বাস করেনি আমার কথা। তাই এখন আমাদের নেতাই শেষ সম্বল। আমি উনার কাছে গে্লাম......

১৫-০৪-১৯৯৭
আজ আমার দ্বিতীয় মিশন। কি মিশন জানেন? খুন করার মিশন। বিরোধী দল হরতাল দিয়েছে। তাই এখন একটা ইস্যু দরকার যাতে সরকারী দল ও বলতে পারে যে তাদের ও একজন মারা গেছে। আমাকে সেদিন রাতে নেতা চুপচাপ উনার বাসায় থাকতে বললেন। তারপর দিন থানা থেকে ওসি সাহেব আসলে উনি সব চেপে যান। বাসা থেকে লাশ উদ্ধার হয়। কিন্তু রেডিও টিভি পর্যন্ত খবর পৌছায়না।

দিন কয়েক এর জন্য আমাকে আরেক টা এলাকায় পাঠানো হয়। সেখানে আমি বেশ ভাল ছিলাম। চিকিৎসা করানো হল আমার। সুস্থ হলে আমাকে আমার প্রথম মিশনে পাঠাল নেতা। আমাকে এক জন পাতি নেতাকে খুন করতে হবে। খুনের পর লাশ ও গুম করতে হবে।

সেবার আমি ফাইভ স্টার নিয়ে গিয়েছিলাম খুন করতে। হাত অনেক কেঁপেছিল। মারার পর লাশ টা গুম করতে ও অনেক ঝামেলা হয়েছিল। তাই এবার আমাকে আমার পুরোনো অস্ত্র দেয়া হল। সেই লোহার রড। যেটা দিয়ে আমার প্রথম শিকার ছিল ফিরোজ। আমাকে শুধু মাথার পেছন থেকে বাড়ি মেড়ে মেরে ফেলতে হবে সেই পাতি নেতা কে।
নাহ-থুঃ ফিরোজ নামটা মনে আসতেই মুখে থু থু চলে আসল। আমাকে এগিয়ে যেতে হবে খুব আসতে আসতে। সামনে বসে থাকবে খুনি।

অনেক ক্ষন ধরে বসে আছি।কিন্তু কেউ আসছেনা। কি হল- আমাকে একটা খুন করতে বলা হল- সামনে বসে থাকবে খুনি। লম্বা পাচফুট চার- কালো চেহারা। চুল কোঁকড়া। এমন একজন। ও নেতা আবার সবুজ শার্ট ও পড়ে আসবে। এইত আমাকে যা বলা হয়েছে। কিন্তু সে রকম তো কেউ আসছে না। যেখানে বসে আছি- পুরো এলাকা শুনশান। কখন যে আসবে সেই শিকার- আমি শিকারী তাকে খুন করবো কে জা্নে...

ওই ত দেখা যাচ্ছে শিকার আমার- সোনা তুমি আসতে অনেক দেরি করে ফেলেছ। ওই ত- বাইকে করে এসেছে। পাতি নেতা বলে কথা। ঐযে হাতে লাল স্কার্ফ- লাল স্যান্ডো গেঞ্জি- উচ্চতা মাপা যাচ্ছেনা। তবে মাথার চুল কোঁকড়া। আমাকে পেছন থেকে যেতে হবে। পেছন থেকে মাথার বামে এলাকায় জোড়সে একটা মারলেই বেচারা শেষ।

কিন্তু একি? ও যাচ্ছে কোথায়? আমাকে না বলা হল ও অনেক ক্ষন থাকবে। আমাকে তাহলে কি ব্লাফ দিল ওরা? এখন আমি কি করবো? আমি কি ফিরে যাব? চিন্তা করতে করতে ঘুরতে গিয়েই দেখি আমার পেছনে সেই পাতি নেতা।
দূর থেকে আমি তাঁর চোখ দেখিনি। এখন দেখতে পাচ্ছি। টকটকে লাল। আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ও তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমার হাতে লোহার রড টা ধরা। কিন্তু আমি মারার চিন্তা করার আগেই দেখতে পেলাম একটা সাদাটে ঝলক- তারপর সব ফাঁকা .....

..............................................................................................................................................................................................................................................................................................................
দুই দিন পর একটা লাশ নিয়ে মিছিল করছে দুই টা দল। পুলিশের সাথে ধাওয়া পালটা ধাওয়ায় জখম হয়েছে শতাধিক। দুই দলের সব নেতা সেই লাশকে নিজেদের দলের লোকের লাশ বলে দাবি করছে। কিন্তু সেই লাশের আসল পরিচয় কেউ জানেনা.........

*****লাশের অভিনেতা*****////// রহস্য-রোমাঞ্চ-ভৌতিক গল্প

লাশের অভিনেতা///////০৪-০৯-২০১১


চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার-মাঝে মাঝে খানিকটা কৃত্রিম আলোক। ঝিঁঝিঁ পোকার কৃত্রিম ডাক। আর কোন সাড়াশব্দ নেই- এমন একটা পরিবেশে অনেক দূর থেকে শোনা গেল -"লাইট -ক্যামেরা- অ্যাকশন"। আমি যেখানে শুয়ে আছি সেখানে শোয়ানো আছে আমার মত আরো তিনজন অভিনেতা। আমি সহ মোট অভিনেতা চারজন। এই হরর ফিল্মটার শুটিং হচ্ছে এফডিসিতে- চার নম্বর ফ্লোরে। আমি নতুন অভিনেতা। এর আগে মাত্র একটা হরর ফিল্মে অভিনয় করেছি মাত্র- তাও একটা লাশের ভুমিকায় মিনিট খানেক এর অভিনয়। আমি কোন কাজ ও পাচ্ছিলাম না মনের মত। আমি এর আগের অভিনয়ের জন্য বেশ ভাল একটা রোল পেয়েছিলাম। কিন্তু গোলমাল বাঁধে একদম শেষ এ গিয়ে। আমি ভুল করে লম্বা একটা শর্টের একদম শেষ তিন সেকেন্ড এর আগে শ্বাস নিয়ে ফেলি। কেঁপে ওঠার জন্য আমার এই শর্টটাই বাদ দিয়েছিলেন আগের ছবির পরিচালক- কারন এর আগে প্রায় ১০ মিনিটের শর্ট নেইয়া হয়ে গিয়েছিল এবং তাতে খরচ হয়ে গিয়েছিল প্রায় দুই লাখ টাকার কাছাকাছি। তাই আমাকে একদম একটা বাজে মরা র পার্ট করতে দেন করুনা করে। এই একটা পার্টের জন্য আমাকে বর্তমান ছবির পরিচালক এর কাছে ধরনা দিতে হয়েছে অনেক বার। হাতে পায়ে ধরে টাকা না নেবার শর্তে আমি রাজি হই এই মরার ভুমিকায় অভিনয় করতে। কোন কারনে আমার ভুল হলে টাকা দেবেন না আমাকে এই শর্তে আমি এখন শুয়ে আছি এই ফ্লোরের নকল স্টেজ এর একপাশে একটা কফিনের সাথে হেলান দিয়ে।


অনেক বার অনুরোধের পর এই রোল আমি পেলেও এতে অনেক রিস্ক ছিল। কারন আমার শরীরে একটা ইঞ্জেকশন নিতে হয়েছে আমার সকল পেশিকে ঘণ্টা খানেক এর জন্য অলস করে দেবার জন্য। এই ইঞ্জেকশন নেবার পর প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেছে। এর মাঝে আমার হার্ট বিট কমে দাড়িয়েছে মোটে ৩০ এর ঘরে। খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। নিচ্ছি না- নিতে বাধ্য হচ্ছি। কারন আমি মরার মত পড়ে আছি চারটা ক্যামেরার সামনে। শর্ট টেক শেষ হলে ই আমাকে আরেকটা ইনজেক্ট করে ঠিক করে দেয়া হবে- এমনটাই বলেছেন ছবির পরিচালক ইসহাক সাহেব।আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম-কিন্তু শেষে চিন্তা করলাম- অনাথ পরিবারের সন্তান আমি - কিছু টাকা পেলে এই মাসটা কিছুটা শান্তিতে কেটে যাবে। কাজটা না পেলে আমার আগের খারাপ রেকর্ডের কারনে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে প্রায় সারা মাস। এর চেয়ে কয়েক ঘণ্টায় হাজার দশেক টাকা পাওয়া যাবে ভেবে এই লাশের ভুমিকায় আমি পড়ে আছি। দেখতে হয়তবা সত্যিকারের লাশের মতই লাগছে আমাকে।


শর্ট টা ছিল এরকম যে কিছু লাশ পড়ে থাকবে এদিক সেদিক। একটা টেবিলে অনেক গুলো অস্ত্র থাকবে- যেমন চাপাতি ছুড়ি ইত্যাদি। এর মাঝে একজন কসাই এসে লাশ গুলো কাটতে শুরু করবে। আমাকে ইসহাক সাহেব অভয় দিয়েছিলেন এই বলে যে এই কসাইয়ের ভুমিকায় তিনি নিজে অভিনয় করবেন। উনি আমাকে কথাটা বলে উপরে বেশ গর্ভবোধ করলেও ভেতরের খবর হল -ডামি হলেও কোন লাশের হাত পা কাটতে কোন কেউ রাজি হয়নি। উনার বাজেট ও এমন নেই যে কেউ সাধে এসে রাজি হবে। আমার মতই তিনি ও খরচ বাঁচাতে নিজেই অভিনয় করতে যাচ্ছেন। উপরে উপরে খুশি হলে ও ভেতর ভেতর কেমন যেন ভয় পাচ্ছিলাম-কারন শক্তিমান অভিনেতা শাকিল খান পর্যন্ত এই ছবিতে অভিনয়ের অফার ফিরিয়ে দিয়েছেন এতে বাজেট খুব কম বলে।আর শাকিল খানের মত অভিনেতার কি দায় পড়েছে যে উনি একটা কসাইয়ের ভুমিকা করবেন- তাও সব অখ্যাত মানুষের ভিড়ে? তাই কাউকে রাজি করাতে না পেরে শেষে নিজেই শুরু করলেন অভিনয় পরিচালক ইসহাক সাহেব।


অ্যাকশন শব্দ শোনার কিছুক্ষন পর অভিনয়ের এলাকায় প্রবেশ করল কসাই।কিন্তু ইহসান খান কে ছাপিয়ে গেছে কসাইয়ের অভিনয়। আর মেকআপ এত ভাল হয়েছে যে আমি ই চিনতে পারছিনা। বয়স এক লাফে ৪৫ থেকে নেমে এসেছে ২৫ এর কোঠায়। আমি আগেই বলে রেখেছিলাম ইহসান খান কে যে আমি লাশের ভুমিকায় অভিনয় করলে ও চোখ খোলা রাখবো। প্রথমে গাইগুই করলেও পরে রাজি হন তিনি দুই ডোজ ঔষধ ইঞ্জেকশন দেবেন এই শর্তে। মেকআপ রুম থেকে লাশের মেকআপ আর কস্টিউম পড়ে যখন উনার রুমে গেলাম তখন উনি মাত্র মেকআপ নিচ্ছেন। আমি যাওয়ার পর তিনি নিজেই আমার হাতে ইনজেকশন দিলেন। এটা পুশ করা মাত্রই মনে হয়েছে আমার শরীরের একটা পেশী ও কোন কাজের না। সব যেন একটা একটা করে ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই থেকে আমি শুয়ে আছি এই কাঠের বাক্সের উপর। কোনরকমে চোখ মেলে তাকাতে পারছি। মস্তিষ্ক কাজ করছে-কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে। কানে ভালই শুনতে পারছি। বস্তুতই একটা লাশের মত অবস্থা আমার।তিনজন লোক আমাকে ধরে এই খানে শুইয়ে দিয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে ক্লান্তিকর অপেক্ষা।


ভৌতিক পরিবেশ বেশ ভালভাবেই জমিয়েছে ইহসান খানের স্টেজ শিল্পীরা। চারপাশে ধোয়া ধোয়া অন্ধকার। একটা হালকা আলো ছড়িয়ে পড়েছে আমি সহ তিন লাশের ডামির উপর। আর কোন আলো ছিলনা। আর এখন আরেকটা লালচে আলো এখন ইহসান খানের উপর। ইহসান খানের পোশাকটা ও সেই রকম ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছে কোন এক ইংরেজি মুভি থেকে ঊঠে এসেছেন মৃত্যুপুরীর কসাই।বেশ পরিণত মেকআপ। আমি ও চিনতে পারছিনা ভাল মত। সেটে এসেই ইপুন অভিনয় শুরু করে দিয়েছেন। একটা টেবিলের উপর সাজানো ছিল নানা রকম অস্ত্র ও সরঞ্জাম। সেখান থেকে একটা চাপাতি তুলে নিয়ে নিখাদ কসাই এর মত ধার পরীক্ষা করলেন চোখ দিয়ে। তারপর টেবিলে রাখা একটা ডামি র পায়ের নিচ দিক থেকে কাটতে শুরু করলেন। বাহ কি নিপুন অভিনয়। যেন ইহসান খানের জন্মই হয়েছে কসাই এর ভুমিকায় অভিনয় করার জন্য।

সেটে সুনসান নিরবতা। শুধু কসাই এর একটানা থপথপ মাংস কাটার শব্দ শোনা যাচ্ছে। টেবিলের উপর রাখা একটা কাটা পা কে কেটে পাঁচ টুকরা করলেন কসাই সাহেব।যে এই হাড় বানিয়েছে তার জুড়ি মেলা ভার।আমি দশ হাত দূর থেকে হাড়ের সাদা অংশ আর চুইয়ে পড়া রক্তের মাঝে লালচে মাংস দেখতে পাচ্ছি। আজ থেকে ইহসান সাহেব কে এই নামেই ডাকবো আমি। অন্তত আমি এই অভিনয় করতে পারতাম না। একবার ও কাট না বলে এভাবে একটানা অভিনয় করা সহজ কথা না।


উফ আর পারলাম না। চোখের পাতা নবম বারের মত বন্ধ করে আবার খুললাম আমি। এবং সাথে সাথে ভয়ঙ্কর ভাবে কসাই আমার দিকে তাকাল। এই প্রথম মনে হল এই চোখ ইহসান খানের চোখ নয়। আমি ইহসান সাহেব কে ভালভাবেই চিনি। ইনি ইহসান খান হতেই পারেন না। হয়ত অভিনয়ের আগে উনি আরেকজন অভিনেতা পেয়ে গেছেন। কিনবা অন্য কোন মানুষ চলে এসেছে সেট এ। আমার দিকে খানিক টা তাকিয়ে থপ থপ করে আমার সামনে এসে আমাকে পাজকোলা করে নিয়ে গেল ফেলল বড় টেবিলটার উপর। তারপর একটা ছুড়ি দিয়ে আমার গায়ে পড়া টিশার্ট ছিড়ে ফেলল দুই ভাগ করে। কথা ছিল এরপর একটা ধামা নিয়ে কোপ দেবার আগেই ইহসান সাহেব কাট বলে শর্ট শেষ করবেন। কিন্তু কসাই বাবাজি বোধহয় ভুলে গেছে আমার টিশার্ট কাটার সময় আস্তে করে ছুড়িতে চাপ দেবার কথা। এত জোরে চাপ দিয়েছে ছুড়িতে যে আমি নিজেই বুঝতে পারছি ছুড়ির একটা কোনা লেগে আমার বুকের কাছটায় সৃষ্টি হয়েছে একটা লাল দাগ। আমি বেশ ব্যাথা পেলাম। কিন্তু এই সময় কোনভাবেই শ্বাস নেয়া যাবেনা। তাই মরার মত পড়ে রইলাম আমি। টিশার্ট ছিড়েই হিংস্র একটা হাসি দিল কসাই। শুনেই বুকের ভেতরটা দুপদুপ করে উঠল। তারপর একটা ধামা হাতে নিয়ে ভালমত ধার পরীক্ষা করে একটা হাসি দিল সে। এবং মাথার উপর ধামাটা ধরে কোপদিতে যাবে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়াল কসাই- এবং শর্ট শেষ।


কিন্তু না-কাট শব্দটা কেউ চিৎকার করে আগের মত বল্লনা। কেউ কাট শব্দটা এখন ও বলছেনা। পরিচালক যদি আমার সামনে কসাই এর ভুমিকায় হয় তাহলে সে কেন কাট বলছে না? সে কেন আস্তে আস্তে ধামা নামিয়ে আনছে আমার ডান পায়ের গোড়ালির দিকে? কেউ কাট বলেনি –তাই ক্যামেরা রোলিং করে চলেছে। এবং আস্তে আস্তে ধামাটা নেমে আসছে আমার পায়ের দিকে। আমি বুঝতে পারছি কোন একটা দারুন ভুল হতে চলেছে।কিন্তু আমি মুখ নাড়াতে পারছিনা। আমি কিছু বলে ঊঠার আগেই ধামাটা এসে কোপ বসাল আমার ডান পায়ে। এবং এক কোপে আমার পায়ের একটা অংশ কেটে ফেলল কসাই। উফ তীব্র যন্ত্রনায় আমার মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত কেঁপে উঠল। আমার হার্ট বিট বেড়ে গেল প্রচন্ড গতিতে। রক্তের ধারায় ভিজে গেল আমার আরেকটা পা। আমি টের পাচ্ছি গরম তরলের অবিরাম ধারা-বের হয়ে যাচ্ছে আমার শরীর থেকে। কিন্তু আমি আমি কাউকে জানাতে পারছিনা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে আমার দেহ। আমার দিকে আরেকবার তাকিয়ে আবার ধামা তুলে ধরল কসাই। এবার ধামাটা এগিয়ে আসছে আমার গলার দিকে। আমি শেষ বার নিঃশ্বাস নিলাম প্রাণ ভরে। ঠান্ডা বাতাসে শেষ ছোয়া এসে ভরিয়ে দিল আমার ছটফটে ফুসফুস ...




পরদিন আবার শ্যুটিং এর সেট ফেলা হয়েছে এফডিসির পাঁচ নম্বর ফ্লোরে।চার নম্বর ফ্লোরে “তুমি আমার প্রেম” সিনেমার গানের শ্যুটিং হবে। তাই পাঁচ নম্বর ফ্লোরে সেট সাজানোর জন্য টিম প্রস্তুত।“কসাই” ছবির পরিচালক ইহসান খান নিজে এসে বুঝিয়ে দিলেন ডিজাইনার দের কিভাবে সাজাতে হবে।ওদের দেয়া হয়েছে চাপাতি, ধামা সহ অনেক গুলো অস্ত্র। সাথে নকল হাত ,পা, রক্ত ইত্যাদি। একটা কম বয়সী ছেলে আজ এসেছে এখানে সেট সাজাবার জন্য। সে এক মনে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে একটা কাটা মাথার দিকে। প্রথমে চিনতে পারেনি। কিন্তু পরে চিনেছে এটা নতুন অভিনেতা নিয়াজ মোরশেদ এর মত। যেই বানিয়েছে অবিকল বানিয়েছে। গতমাসে নিয়াজ মোরশেদের সাথে প্রথম দেখা। একটা পার্ট দেবার জন্য অনেক ধরেছিল। তাই ইহসান খানের কাছে নিয়ে গিয়েছিল সে। এই কথা গুলো ভাবতে ভাবতে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল সে- হটাত ইসহাক সাহেবের ধমক খেয়ে মাথাটা টেবিলের উপর রেখে আবার কাজে মন দিল সে। এরপর কাটা হাত পা গুলো আংটা দিয়ে দেওয়ালের সাথে ঝুলাতে ব্যাস্ত হয়ে গেল সে ...

(সমাপ্ত)

####সিংহাসন #### রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প

/////////////////////////////////////সিংহাসন///////////////// ০২/০৯/২০১১


আজ আপনাকে এক অদ্ভুত গল্প শোনাবো। যদি ও জানি আপনি এর এক দন্ড ও বিশ্বাস করবেন না। ভাববেন আমি পাগল কিনবা বদ্ধ উন্মাদ। কিনবা মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসা কেউ।কিন্তু বিশ্বাস করেন আমি আজ যে কথা গুলো বলবো তাতে বিন্দু মাত্র মিথ্যা লুকানো নেই। আমি লেখক হতে পারি, বানিয়ে বানিয়ে প্রচুর গল্প লিখতে পারি - কিন্তু আমি আজ যে জিনিসটা নিয়ে আপনাদের কাছে লিখছি সেটা আমার সামনেই আছে। একটা সামান্য সিংহাসন মাত্র এটা। আমি এটাতে বসেই লিখছি আপনার কাছে। আমি এটা সম্পর্কে যা যা লিখবো সব সত্য লিখবো এটা প্রতিজ্ঞা করেই শুরু করলাম।

ঘটনার শুরু যখন আমি মেসে থাকি- ঢাকায় এক অভিজাত এলাকায়।বাবার অনেক টাকা থাকায় আমোদ ফুর্তিতে আমি ছিলাম একেবারেই মত্ত। আমি পড়তাম এক অভিজাত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে। সারাদিন আড্ডা- নেশা করা- বিভিন্ন যায়গায় হটাত করে চলে যাওয়া ছিল আমার নিত্য দিনের অভ্যাস। আমি কুমিল্লার ধর্ম সাগরে নেশা করে নৈকায় ঘুরেছি- সমুদ্রে চাঁদের আলোর নিচে বসে বসে বন্ধুদের মাঝে বিলিয়েছি ঘুমের মন্ত্র। নীল পাহাড়ে গিয়েছি একদম ঠান্ডার মাঝে। এসব করে অভিজ্ঞতা ও আমার কম হয়নি। আমি সেই অভিজ্ঞতা গুলো জমিয়েই লিখেছি ১০ টা উপন্যাস। সব গুলোই বই আকারে আছে। আপনারা হয়ত "নীলাভ তারার কালচে আলো" উপন্যাস টা পড়েছেন। এইত কদিন আগে ঈদে এটা থেকে নাটক হয়ে গেল। জাহিদ হাসান আর জয়িতা অভিনয় করেছিল। যাই হোক সেই এক সময় আমি গিয়েছিলাম সুন্দর বন। সময়টা বেশিদিন আগের না। মাত্র তিন মাস আগে। প্রথমে গিয়েছিলাম খুলনা- সেখান থেকে বরগুনা ঘুরে সুন্দরবন ।

একসপ্তাহ ছিলাম আমি সেখানে- সাথে ছিল আমার তিন মেস মেট। আমরা একসাথেই পড়ি। লেখা পড়া শেষ হবার উপলক্ষে আমাদের এই ট্যুরের স্পন্সর আমি। ফেরার আগেই ছয়দিন আমরা অনেক অনেক আনন্দ করেছি। টাকা খাইয়ে এক বনবিভাগের লোক কে আমরা ঢুকে ছিলাম চিত্রা হরিণ শিকার করতে। আমি নিজেই একটা মেরেছি। সেটার মাংস পুড়িয়ে খেয়েছি নদীর পাড়ে। আমি যেখানেই যাই অঢেল টাকা নিয়ে যাই। সেবার ও নিয়েছিলাম অনেক টাকা। ইচ্ছা ছিল সব ঊড়িয়ে খালি হাতে দেশে ফিরব। কিন্তু হলনা।

সুন্দরবন থেকে ফেরার পথে আমরা খোঁজ পেলাম একটা বজরার। এটা এক সৌখিন মানুষ সুজন মোল্লার। উনার বজরা তে আমরা ঊঠেছিলাম শুধু মাত্র নৌকা ভ্রমণের জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়েই আমরা জানতে পারি এই বজরা ছিল কুখ্যাত ডাকাত করিম মোল্লার। এবং এই সুজন মোল্লা তার ই সন্তান। শুনে তো আমরা অনেক ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু আমাদের সুজন মোল্লা অভয় দেয়। সে এখন ডাকাতি করেনা। তার বাবার রেখে যাওয়া অঢেল টাকা আছে। সে কোন কাজ করেনা- পায়ের উপর পা তুলে খায়। এভাবে কথায় কথায় আমাদের সাথে সুজন মোল্লার বেশ ভাব হয়। আমরা সেইদিন রাতে বজরায় একসাথে জোছনা দেখলাম।

পরদিন আমাদের তিনজন কে সুজন মোল্লা কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখালো। সেগুলো ছিল তার ই বাবার রেখে যাওয়া ডাকাতির মাল পত্র। এর মাঝে একটা সিংহাসন দেখলাম আমি। দেখেই আমার খুব ভাল লেগে গেল। আমি এটার কাহিনী জানতে চাইলেই উনি বললেন আজ থেকে প্রায় বছর পঞ্চাশ আগে একবার ডাকাতি করতে গিয়ে আরেক ডাকাত এর সাথে লড়াই করে এই সিংহাসন কেড়ে নেন করিম মোল্লা। সেই ডাকাত- যে এই
সিংহাসন এর মালিক ছিল - সে এটা পেয়েছিল তার বাবার কাছ থেকে। তার বাবা ছিল ব্রিটিশ আমলের কুখ্যাত ডাকাত নিরঞ্জন পালী। তিনি এটা নিয়ে এসেছিলেন উত্তর বাংলার জমিদার জ্ঞানদা চরণ মজুমদার এর সভাকক্ষ থেকে। নিরঞ্জন পালী বেশ হিংস্র ছিলেন। তিনি যখন এই সিংহাসন কেড়ে নিতে যান তখন এটাতেই বসা ছিলেন জ্ঞানদা চরণ। একটা তলোয়ার জ্ঞানদা চরণের পেটে আমুল বসিয়ে লাশ সহ সিংহাসন নিয়ে আসেন তার আস্তানায়। সেখান থেকে হাত ঘুরে এই বজরায়। এটা পাওয়ার পর প্রায় ১৫০ বছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু এখন ও সিংহাসনটার অদ্ভুত জেল্লা দেখে আমি অবাক হলাম।সিংহাসন এর উচ্চতা আনুমানিক চার ফুট। সবার উপরে একটা ময়ুরের মাথা আর পালক। সেই পালকে গাথা শ'খানেক মুক্তা আর নীলা। দুই হাতলে আছে অদ্ভুত সিংহ খচিত কারুকাজ। হাতলের শেষে সিংহের মুখ হা করে আছে। আর চোখ দুটো তে উজ্জ্বল পাথর। পিঠের নিচে আছে মখমলের নরম আবরন। পায়া চারটার মাঝে জ্বল জ্বল করছে সাতটা করে নীলা। কালচে রং এর কাঠের আবরনে এখন ও কেমন যেন রাজা মহারাজা আবেশ ছড়িয়ে আছে।

আমি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিলাম সিংহাসনটার দিকে। আসলে এই রকম একটা জিনিস এই ভাঙ্গা বজরাতে থাকতে পারে সেটা নিজের চোখেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। যাদুঘরে রাখার মত এই সম্পদ এই আস্তাকুড়ে নৌকায় পড়ে আছে ভাবতেই মনটাই খারাপ হয়ে গেল। আমার সাথে এক লাখের মত টাকা ছিল। আমি সুজন মোল্লা কে তখন ই সিংহাসনটা কেনার জন্য আবদার করলাম।সুজন মোল্লা ও না করেনি। আমাদের কে জিনিস গুলো দেখানো মানেই ছিল এগুলো আমাদের কাছে বিক্রি করে তার পেট চালানোর ধান্ধা। কিন্তু সে যা দাম চাইল তাতেই মাথায় হাত পড়ল আমার। সেই এই সিংহাসন এর দাম হাঁকল দশ লাখ টাকা। আমি ঊষ্ণা প্রকাশ করতেই সে একজন জহুরী ডাকাল। সেই জহুরী প্রতিটা পাথর আমাদের সামনে পরীক্ষা করে জানাল প্রতিটি পাথর ই মহামুল্যবান। সব মিলিয়ে এই সিংহাসন এর দাম কম করে হলেও কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

আমি সেই দিনেই আব্বাকে ফোন করে টাকার ব্যাবস্থা করলাম। উনি সাথে দুইজন লোক ও পাঠিয়ে দিলেন। ঐ লোকগুলো সিংহাসনটাকে নিয়ে রওনা দেয় আমার মেসে এর উদ্দেশ্যে। আমি ঢাকায় পৌছানোর একদিন পরেই ঢাকায় পৌছায় আমার সিংহাসনটা।

কিন্তু এটা আনার পরদিন ই এক অদ্ভুত কান্ড ঘটে। রাতে আমি একটা অ্যাসাইনমেন্ট এর কাজ এ দেরী করে ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে ঊঠে দেখি সিংহাসন এর বসার যায়গায় মরে পড়ে আছে একটা বাচ্চা ইদুর।আমি কাজের বুয়া কে ইদুরটা সরাতে বলেই চলে গেলাম ভার্সিটি। যখন ঘরে ফিরি তখন সন্ধ্যা। আমি কলিং বেল অনেক বার টিপে ও কেউ খুলে না দিলে দাড়োয়ান ডেকে দরজা ভাঙ্গার ব্যাবস্থা করি। এবং দরজা ভেঙ্গে আমার রুমে গিয়ে যা দেখি তার জন্য আমি কোনদিন প্রস্তুত ছিলাম না। দেখলাম সিংহাসন এর উপর কাজের বুয়া অদ্ভুত ভাবে পড়ে আছে।
নাক দিয়ে রক্তের একটা ধারা। আর কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। দেখে আমি হতভম্ভ। তাড়াতাড়ি হাসপাতাল নিয়ে যাই। সেখানে জানায় সে মারা গেছে অনেক ক্ষন আগে। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারনে। ডাক্তার পুলিশ কেস করতে বলেছিল। আমি টাকা খাইয়ে ডাক্তার কে ম্যানেজ করি। টাকা খাইয়ে দাড়োয়ানের মুখ ও বন্ধ করি। এবং কাজের বুয়ার পরিবার কে দশহাজার টাকা দিয়ে চুপ থাকতে বলে ছেড়ে দেই সেই মেস। এবং সিংহাসনটাকে পাঠিয়ে দেই আমার গ্রামের বাড়িতে। সেখানে আব্বাই আমাকে সেটা পাঠিয়ে দিতে বলেন।

এবং আমার দুর্ভাগ্যের শুরু সেখান থেকেই। দুই সপ্তাহ পর বাসা থেকে জরুরী ফোন আসল। বলা হল আমার খালা খুব অসুস্থ। আমি যেন চলে আসি। আমি তড়িঘড়ি করে গিয়ে দেখি খালা মারা গেছেন। আমি লাশের মুখ টা দেখতে চাইতেই দেখলাম খালার নাকের কাছে জমে থাকা লালচে রক্ত। বুঝতে বাকি থাকল না যে খালা সেই সিংহাসন এ বসেই মারা গেছেন।

আমি সেইদিন ই জানাজার পর ফোন করলাম সুজন মোল্লা কে। সে আমাকে জানাল এই সিংহাসন অভিশপ্ত। কেউ এটাতে বসলেই সে একটা ঘোরের মাঝে চলে যায়। তারপর সে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে। সেই ঘুম কখনো ভাঙ্গে না। এতেই সুজন মোল্লার বাবা করিম মোল্লা মারা যান। এটাতেই মারা যায় সুজন মোল্লার মেয়ে জামাই।এই কথা আমাকে আগে কেন জানায় নি জানতে চাইতেই ঐ পাশ থেকে ফোন কেটে দেয় সুজন মোল্লা। বুঝলাম ডাকাতি না করলে ও স্বার্থের জন্য করেনা কিছু বাকি নেই তার। দশ লাখ টাকার জন্য মেরে ফেলেছে দুজন মানুষ কে। আমি সেই দিন ই লুকিয়ে ফেললাম সিংহাসনটাকে। বাড়িটা বিশাল আমাদের। পুরোনো বাড়ি- অনেক গুলো রুম। আমি একটা স্টোর রুমে লুকিয়ে ফেললাম সেটাকে। কিন্তু থামাতে পারলাম না মৃত্যু।

ঠিক দুইদিন পর খবর আসল আমার বড় ভাই মারা গেছেন। আমি গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখলাম ভাইয়ার ও একই অবস্থা। নাকের কাছে এক ফোঁটা রক্ত। বুঝলাম ভাইয়া কোন একটা কাজে সেই স্টোর রুমে গিয়েছিলেন। গিয়েই চেয়ারটা দেখে লোভ সামলাতে না পেরে বসে পড়ে। আর মারা যায়। আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে গেলাম।ভাইয়ার মৃত্যু কে আমার আম্মা মেনে নিতে পারেন নি। তিনি পরদিন স্ট্রোক করে মারা যান। এবং একে একে আমাদের পরিবারের এগার জন এই সিংহাসন এ বসে বসে মারা গেলেন। আমি শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছু ই করার ছিলনা। কারো কাছে বিক্রি ও করতে পারছিলাম না লুকিয়ে ও রাখতে পারলাম না। যেন একের পর এক মানুষ কে টেনে নিয়ে মারে ইচ্ছা মত সিংহাসনটা।আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে একটু আগে আমার আব্বাকে কবর দিয়ে এসে সিংহাসনটাতে বসেই লিখছি এই সব।

বিশ্বাস করেন এর একবিন্দু ও মিথ্যা না। আমি যা যা লিখেছি তার সব সত্য। যেমন একটু আগে থেকে আমি একটা খুব সুন্দর মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। চমৎকার একটা শাড়ি পড়ে আছে। হাতে একটা থালা। তাতে নানা রকম ফল। আমি লেখার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটাকে দেখছিলাম। এখন মেয়েটা আস্তে আস্তে সামনে এসে আমাকে ফল খাওয়ালো। আমি ও খেলাম।কি ফল জানিনা। কোনদিন খাইনি। কিন্তু আশ্চর্য স্বাদ। মেয়েটা এরপর থালাটা মাটিতে রেখে নাচ শুরু করল। আমি ঊঠে মেয়েটার সাথে নাচতে চাইলাম। কিন্তু আমাকে জোর করে বসিয়ে দিল আরো দুই জন হটাত করে উদয় হওয়া মেয়ে। তারপর আমাকে একজন একটা হাত পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। আরেকজন একটা রুপার পাত্রে ঢেলে দিল মদ। আমি মদ খেয়ে মাতাল হতে শুরু করেছি। তাই লিখতে পারছিনা। হয়ত এটাই আমার জীবনের শেষ ক্ষন। কারন একটু আগেই নাকের কাছে একটা সরু রক্তের ধারা টের পেয়েছি। কিন্তু কিছুই করার নেই। আমি ঊঠতে পারছি না সিংহাসন ছেড়ে। মেয়েটার নাচের তাল বেড়েই চলল। কেউ একজন হাতের তালি দিয়ে তবলার বোল দিচ্ছে। মেয়েটা নেচে চলেছে। তা ধিন ধিন ধা তা ধিন ধিন ধা- না তিন তিন না- তেটে ধিন ধিন ধা- ধা- আহ মাথার চার পাশ কেমন যেন হালকা হয়ে আসছে। এখন সামনে শুধু মেয়েটা নাচছে। আর কিছু শুনতে পারছিনা। খুব ঘুম পাচ্ছে। প্রচন্ড ঘুম। আমি ঘুমালাম- জীবনের শেষ ঘুম। আপনি এই সিংহাসন টাকে ধবংস করে দেবেন। ভুলেও লোভে পড়ে এতে বসবেন না। বসলেই নিশ্চিত মৃত্যু ................
ইতি রাওসিভ হাসান.।.।


দুই মাস পর

বর্ষা যাদুঘরে এসেছে ওর মা বাবার সাথে।ওর খুব শখ পুরাত্ন জিনিস পত্র দেখার। তাই প্রতিমাসে সে আসে জাতীয় যাদুঘরে। দেশের প্রায় প্রতিটি যাদুঘরে ও ঘুরে ঘুরে সব মুখস্থ করে ফেলেছে। কিন্তু সে এখন তিন তলার ডান পাশের রুমে নতুন যে সিংহাসন টার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেটা সে আগের বার আসার সময় দেখেনি। তাই মন যোগ দিয়ে সিংহাসন এর সামনে লেখা বর্ণনা পড়তে লাগল। তাতে লেখা-

" পশ্চিম বাংলার জমিদার জ্ঞানদা চরণ এর হারিয়ে যাওয়া সিংহাসন এটা। পাওয়া গেছে গাজিপুরের হাসান পরিবারে। সিংহাসনটা জ্ঞানদা চরণ নিজে বসার জন্য বানায় নি। সেটা বানিয়ে ছিলেন তার ভাই রুক্ষদা চরণের জন্য। এটা ছিল একটা মরন ফাঁদ। এই সিংহাসন এর সব খানেই মেশানো আছে একধরনের অজানা বিষ। এই সিংহাসন এ বসলেই এই বিষ প্রবেশ করে বসা ব্যাক্তির উপর। তারপর আস্তে আস্তে ঐ ব্যাক্তির মৃত্যু হয়। জ্ঞানদা চরণ তার ভাইকে মারার জন্য এটা বানালে ও কুখ্যাত ডাকাত নিরঞ্জন পালী এটাকে হস্তগত করে। এর পর প্রায় ২০০ বছর এটার অস্তিত্ব অজানা ছিল। একমাস আগে হাসান ফ্যামিলির রাওসিব হাসানের মৃতদেহ আবিষ্কারের মাধ্যমে এটা ঊঠে আসে সভ্যতার সামনে। নিরীহ দর্শন এই সিংহাসন হত্যা করেছে প্রায় ৪০ জনের মত নিরীহ মানুষ কে। তাই এটা থেকে দূরে থাকুন ................

লেখাটা পড়েই বর্ষা খুব ভয় পেল। তারপর দৌড়ে চলে গেল ওর বাবার কাছে ...........


( সমাপ্ত )

☠☠☠☠পরিবর্তন ☠☠☠☠ রহস্য-রোমাঞ্চ-ভৌতিক গল্প

পরিবর্তন///////// ১৪/১০/২০১১



"ওকে কিভাবে তৈরি করা হবে? "

" কেন যেভাবে ভাবা হয়েছিল"

"তাহলে দেরী কেন?"

" শুরু হোক"

" কোথা থেকে শুরু হবে?"

"মাঝ থেকে-মেরুদন্ডের মাঝ থেকে"
..........................................................................................





দিন ১


কোমরের মাঝে প্রচন্ড ব্যাথা।চিনচিনে ব্যাথা। হটাত হটাত ব্যাথার ঢেঊ উঠে ঊঠে আসছে মাথার দিকে। যখন আসে তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। আশে পাশে কেউ নেই। একা একা থাকি। কাউকে জানাতে ও পারছিনা।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হচ্ছে হটাত হটাত। এরকম ব্যাথা কল্পনাই করা যায় না। কি হবে আমার? উফফ- বসলে উঠতে পারিনা। উঠলে বসতে পারিনা। ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। আশে পাশে কোন ডাক্তার ও নেই। কার কাছে যাব। থাকি মফস্বলের এই বাসায়। তাও একা। সকালে অফিসে খাই। রাতে অনেক দুরের হোটেল থেকে খেয়ে আসি। এখন কিভাবে আমি ডাক্তার এর কাছে যাব? একজন ডাক্তার আছেন। কিন্তু তাও অনেক দূরে। দেখি সময় করে যেতে হবে।কিন্তু একা একা কিভাবে যাব বুঝতে পারছিনা। বাসায় কেউ থাকলে ভাল হত।

দিন ৩

সারা দিন শুয়ে আছি। মাথা ভারী হয়ে গেছে। শরীরের মাঝে যেন একটা লোহার শলাকা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। কিছু বুঝতে পারছিনা। কি হবে এখন? উফ আর পারছিনা। ব্যাথা দিন দিন বাড়ছে। হাই ডোজ এন্টিবায়োটিক এও কোন কাজ করছেনা। কিছু বুঝতে পারছিনা।উফ মাথা ঘুরছে অনেক। মনে হচ্ছে যেন মাথায় তরল আগুন। এই আগুনের শেষ নেই। জ্বলছে তো জ্বলছেই ।

দিন ৭

ব্যাথা এখন ছড়িয়ে গেছে সারা শরীরে। আমার হাতের কনুই গুলো প্রায় অবশ এখন। আঙ্গুল গুলো নাড়াতে পারি। কিন্তু কেমন যেন অসাড়। পায়ের দিকে তাকাতে পারছিনা। দেখেই ভয় লাগছে। বাম পায়ের গোড়ালি র দিকটায় যেন কেমন ভাবে বেঁকে গেছে। এর ফলাফল কি হবে জানিনা। এখন কুঁজো হয়ে হাঁটতে হচ্ছে। কিন্তু ঠিক সাধারন কুঁজো না। কেমন যেন বেঁকে গেছে পিঠ। ঠিক উলটো ভাবে। আসতে আসতে যেন উলটে যাবে এমন ই মনে হচ্ছে।

দিন ১১

মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা। পা গুলো প্রচন্ড বেখাপ্পা ভাবে বেঁকে গেছে গতকাল রাতে। আমি বুঝিনি কি হয়েছে। আমি শুধু টের পাচ্ছি আমার শরীরের সব কিছু উলটো হয়ে যাচ্ছে। পায়ের দিকে তাকাতে ভয় লাগছে অনেক। গল্পে পড়তাম ভুতের পায়ের পাতা উলটা হয়। এখন আমার নিজের উলটো পায়ের পাতা দেখে কেমন যেন বমি আসছে আমার। প্রচন্ড যন্ত্রনা সারা শরীর জুড়ে। এই কয় দিন কিছুই খাইনি। কেন যেন খিদে লাগেনি। বুঝতেই পারছিনা। আমি কিভাবে না খেয়ে থাকছি এতদিন সেটাই বিশ্বাস হচ্ছেনা। উফ আর ভাবতে পারছিনা।

দিন ১৩
আজকে তের তম দিন। আমাকে এখন আমি নিজেই চিনতে পারছিনা। হয়ত একদিন পর আমাকে আমি নিজেই চিনতে পারবোনা।দাঁত গুলো অনেক লম্বা হয়ে গেছ ভোরের দিকে। কি হবে জানিনা। প্রচন্ড মানসিক চাপ অনুভব করছি। কি হবে জানিনা সব কিছু উলটে গেলে। এখন আমি পুরোপুরি উলটে যাবার অপেক্ষায় আছি।
.............................................................................................


“কেমন হল পরিবর্তন?”

“ অনেক সুন্দর লাগছে ওকে। ঠিক আমাদের মতই”।

“ না আমাদের মত সুন্দর সে নয়। তবে ও যাকে ওর শ্বদন্ত দিয়ে কামড় দেবে-যার রক্ত খাবে তার চেহারা হবে অনেক টা আমাদের মত”।

“ হয়ত...... কে জানে”।

“ হুম এখন আমি সন্তুষ্ট”

“এখন কি করা হবে একে নিয়ে?”

“কেন ? যা পরিকল্পনার শেষ ধাপে ছিল তাই হবে”

“হুম- তাহলে ওকে এখন লোকালয়ে পাঠানো যাক। দেখি ওর থেকে যার পরিবর্তন হবে সে দেখতে কেমন হবে”


“ঠিক। এখন ওকে লোকালয়ে পাঠানো যাক”
..........................................................................................

সুমির কোন ভাবেই ঘুম আসছে না। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা বলে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়েছে। কিন্তু ঘুম আসছেনা।বাইরে চাঁদ নেই। নিকষ কালো অন্ধকার। কিন্তু এক স্নিগ্ধ আলো ঘরে প্রবেশ করছে। রাতে এই আলোকে অনেক উপভোগ করে সে। কিন্তু আজকে অনেক বিরক্ত লাগছে এই আলো। কি মনে করে বিছানা থেকে উঠে এসে বারান্দায় দাড়ালো সে। উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিচে রাস্তার দিকে তাকিয়েই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল সুমি। নিচে কেউ যেন হামাগুড়ি দিয়ে হেটে চলেছে। উপর থেকে দেখে অনেকটা কুকুরের মত মনে হচ্ছে। এগিয়ে আসছে ওদের বাড়ির দিকেই। হটাত ঠিক নিচে থেমে গেল সুমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর সোজা সুমিদের বাড়ির দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে লাগল। হটাত ভয় পেয়ে গেল সুমি। তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকেই বারান্দায় যাওয়ার দরজাটা বন্ধ করে দিল। ও হয়ত জানেনা- কোন ভাবেই জন্তু টাকে আটকানো যাবেনা। সেটা এগিয়ে আসছে সুমির দিকেই////


(সমাপ্ত)

////শেষ রাতের ট্রেন///// রহস্য রোমাঞ্চ ভৌতিক গল্প

শেষ রাতের ট্রেন - ১৯-০৮-২০১১

"এই চা গরম -চা গরম " - চিকন একটা গলায় চিৎকার করে চলেছে মিশকালো একটা লোক- হাতে এক বিশাল চায়ের ফ্লাক্স- চিল্লাতে চিল্লাতে রাজু সাহেবের সামনে মিনিট তিনেক ধরে ঘুর ঘুর করছে। যত বার রাজু সাহেবের সামনে যাচ্ছে ততবার রাজু সাহেব বিরক্ত হচ্ছেন- কিন্তু চা ওয়ালার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই। লাকসামের রেলস্টেশনের ওয়েটিং এ রাজু সাহেব আজ রাত্রের গুটি কয়েক যাত্রির মাঝে একজন। স্যুট বুট পড়া বলে রাজু সাহেবের দিকে বার বার এগিয়ে আসছে একের পর এক হকার। তিনি সবাই কে ফিরিয়ে দিয়েছেন। উনার মা উনাকে ভরপেট খাইয়ে দিয়েছে। আর পই পই করে বলে দিয়েছে যেন তিনি কোন রাস্তার খাবার না খান। আর মায়ের কথা তিনি কোনদিন ফেলতে পারেন না।

"এই ডিম- ডিম ডিম- সিদ্ধ ডিম"- বলে একটা ছোট বাচ্চা এসে ডিমের ঝুড়িটা রাজু সাহেবের সামনে রেখে বলল-
"স্যার একটা ডিম নেন- অনেক ভাল লাগবো- খাইবেন? দিমু? ছুইলা?"
বলেই একটা ডিম নিয়ে ছোলা শুরু করে দিল। রাজু সাহেব ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছেন ডিম ওয়ালা ছেলেটার দিকে। তারপর গলাটা একটু চড়িয়ে বললেন-

"তোমাকে আমি কি ডিম ভাংতে বলসি? তুমি ডিম ভাংলা কেন?"
হলদে দাঁত বের করে ছেলেটা একগাল হেসে বলল-

"স্যার সবাইরে আট ট্যাহা কইরা দেই- আপনেরে ছয়টাহায় দিমু- নেন খাইয়া দেহেন- কেমুন মজা।"
বলে ডিমটা একটা কাগজে নিয়ে চামচ দিয়ে দুই ভাগ করে নুন ছিটিয়ে দিল রাজু সাহেবের হাতে।

রাগে মাথা জ্বলতে শুরু করল উনার। কিন্তু একটু পড়েই নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন- না আমি খাব না। তুমি টাকা নিয়ে বিদায় হও। বলেই মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার একটা নোট দিলেন ছেলেটাকে। ছেলেটা নোট টা নিয়ে ডিম টা রাজু সাহেবের পাশে ব্যাঞ্চে রেখে চলে গেল হন হন করে। সেই ছেলেটার চলে যাওয়া দেখে উনার মাথার ভেতর রাগে জ্বলতে শুরু করল। কিন্তু তিনি মনে মনে বিড় বিড় করে কি যেন একটা বলে আবার মনযোগ দিলেন ট্রেন লাইনের দিকে তাকিয়ে থাকা কে।

রাজু সাহেব থাকেন ঢাকায়। একা একটা ফ্লাট ভাড়া করে। উনি ঢাকা হাইকোর্টের একজন ঊকিল। মা থাকেন লাকসামের ফুল্গ্রামে। উনি অনেক চেয়েছেন মাকে সাথে করে ঢাকায় নিয়ে আসতে- কিন্তু উনার বাব্র কবর ছেড়ে উনার মা আসতে কখনোই রাজি হননি। উনি উনার স্বামীর কবর ছেড়ে কোথাও যান না। তাই আজ রাজু সাহেবের সাথে ও তিনি যাচ্ছেন না। উনাকে যাওয়াত দেয়া হয়েছে সুনামগঞ্জে প্রফেসর আকমল সাহেবের বাসায়। প্রফেসর আকমল এর মেয়ের সাথে রাজু সাহেবের বিয়ের কথা চলছে দুই সপ্তাহ ধরে। শেষে মেয়ে দেখার জন্য আকমল সাহেব রাজু সাহেবের পরিবার কে ডেকে পাঠান। কিন্তু রাজু সাহেবের মা যেতে রাজি হননি। তাই শেষ পর্যন্ত বিয়ে করার জন্য নিজেকেই একা যেতে হচ্ছে রাজু সাহেবের। উনার কোন ভাই বোন ও নেই যে উনার সাথে যাবেন। তাই একা এই মাঘের শীতের রাতে তিনি টিকেট কেটে প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছেন ঢাকা সিলেট গামী ট্রেনের জন্য।

"স্যার স্যার পেপার নেন পেপার- পেপার নেন- গরম গরম খবর - মজার মজার খবর' - বলে উনার সামনে এসে ১৮-১৯ বছরের একটা ছেলে এসে মাসিক পত্রিকা যাচতে লাগলো। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তিনি যাত্রা পথে ঘুমিয়ে কাটান। এই রংচঙে পত্রিকা কোনদিন উনাকে টানেনি। উনি বেশির চেয়ে বেশি দৈনিক পত্রিকা পড়েন। কিন্তু ছেলেটা নাছোড় বান্দা। উনাকে পেপার বিক্রি করে ই ছাড়বে। শেষে বিক্রি করতে না পেরে একটা নগ্ন ছবি ওয়ালা চটি বই রাজু সাহেবের চোখের সামনে ধরে নাচাতে নাচাতে বলল- '

"স্যার দেখেন- কত গরম গরম জিনিস- নেবেন? স্যার আরো ভাল ভাল জিনিস আছে।" বলে দাঁত বের করে হাস্তে লাগল। এবার রাজু সাহেব চোখ বড় বড় করে এমন ভাবে তাকালেন যে ছেলেটা প্রায় পালিয়ে বাঁচল।
উনি এবার নিজের ব্যাগ থেকে একটা শরত সাহিত্য সমগ্র বের করে পড়তে শুরু করে দিলেন। কিছু ক্ষন আগে স্টেশন মাষ্টার জানিয়েছেন- ট্রেন আসতে আসতে আরো দুই ঘণ্টা লাগবে। তাই এই দুই ঘণ্টা কিভাবে কাটাবেন তিনি বুঝে ঊঠতে পারছেন না।

শরত বাবুর বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে তিনি খেয়াল করলেন উনার পাশের হাত বিশেক দূরে একটা দম্পতি নিজেদের মাঝে গল্প গুজব করছে। তিনি প্রথমে ঊঠে গিয়ে উনাদের সাথে ভাব জমাবেন বলে চিন্তা করেছিলেন- কিন্তু পরে চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললেন। একটু পড়েই ঢাকা চট্টগ্রাম গামী ট্রেন আসলে উনারা উঠে চলে গেলেন সেই ট্রেন এ করে। ভাব দেখে উনাদের নতুন বিবাহিত বলে মনে হল। মনে মনে চিন্তা করতে করতে উনি আবার পড়ায় মনযোগ দিলেন।

কিন্তু হটাত করে খেয়াল করলেন উনার চারপাশ কেমন যেন শুনশান - কোন সাড়া শব্দ নেই। বই থেকে মাথা তুলে কান পেটে শুনতে চেষ্টা করলেন রাজু সাহেব। কিন্তু তিনি কোন শব্দ শুনতে পেলেন না। মাথা তুলে দুই পাশ দেখলেন। হালকা টিমটিমে ৪০ ওয়াটের বাতি জ্বলছে চারটা - এতে চারপাশের অন্ধকার আরো গাঢ় বলে মনে হল উনার। এর মাঝে মাঘ মাসের কুয়াশা ও আছে। উনি কান পেতে থাকলেন অনেকক্ষন। নাহ তিনি কোন ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ও শুনতে পেলেন না। এমনিতে তিনি তুখোড় উকিল হলেও একাকীত্ব কিছুটা ভয় পান। তাই বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে স্টেশন মাষ্টারের রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে ও তিনি হতাশ হলেন- সেখানে একটা পাগলি ছাড়া কেউ নেই। স্টেশন মাষ্টার কোন ফাঁকে চলে গেছে নিজের বাড়িতে এটা উনি টের ই পেলেন না। স্টেশন মাষ্টারের বেধে দেয়া সময় এর বাকি আছে মাত্র দশ মিনিট আছে।তিনি ঘড়ি দেখতে দেখতে এসে বসলেন উনার আগের সিটে। এবং বসতে গিয়ে হটাত দেখলেন উনার পাশে এক বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন। উনি গলা খাকড়ি দিয়ে গিয়ে বসে পড়লেন মহিলার পাশে।

এই ঠান্ডায় মহিলা অনেকটা কুকড়ে আছেন। শাদা শাড়ি পড়ে আছেন তিনি। মুখ অনেক তা ঢাকা ঘোমটার আড়ালে। রাজু সাহেব ভাবতে লাগলেন এই শুনশান রাতে মহিলা বসে আছেন কেন – কে তিনি ? কেন এলেন এখানে? এমন টা ভাবতে ভাবতেই মহিলা নিজে নিজেই বললেন-
“ ভাবছেন তো কেন আমি এখানে?”

শুনেই রাজু সাহেব বেশ চমকে উঠলেন। মহিলার গলার আওয়াজ অনেক ভাঙ্গা- শুনে মনে হচ্ছে উনি অনেক কষ্ট করে কথা বলছেন। কথা টা বলেই তিনি রাজু সাহেবের দিকে তাকালেন। রাজু সাহেব সেই দৃষ্টির দিকে বেশি ক্ষন তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। ভয়ে শরীরের ভেতর টা ঘেমে ঊঠল উনার এই শীতের মাঝে। তিনি ভেবেছিলেন কোন এক ভুত উনার পাশে বসে থাকবে। আস্ত মানুষ দেখে কিছুটা স্বস্তি পেলেও মহিলার চোখ দুটি দেখে উনি ভয় পেয়ে গেলেন।

“আমি সুনামগঞ্জ যাব বাবা- সেখানে আমার ছেলের কাছে যাব- শুনেছি ট্রেন আসতে অনেক ক্ষন বাকি তাই আমি ঘর থেকে বের হয়েছি দেরিতে। এখন আসলাম- ঘরের পাশেই মাস্টার সাহেব থাকেন। তিনি আমাকে বললেন- পাঁচ মিনিট পরেই ট্রেন আসবে। তাই আমি চলে আসলাম। আপনার কোন অসুবিধা নেই তো এখানে বসলে? বলেই জ্বলজ্বল চোখে তাকালেন বৃদ্ধা রাজু সাহেবের দিকে।

রাজু সাহেবের বেশ অস্বস্থি হল এই প্রশ্ন শুনে- তিনি মনে মনে অনেক কিছু চিন্তা করলেও ভদ্রতার খাতিরে বললেন- “না না কোন সমস্যা নেই আপনি বসলে- আমি তো এখানে বসার সিট দখল করে রাখতে আসিনি” বলে বইটা খুলে পড়তে শুরু করে দিলেন।

আর মিনিট খানেক পড়েই ট্রেন আসল। তিনি ‘ট’ বগির সামনের একটা সিটে বসে ছিলেন। “ট” বগিটা এসে থামল উনার সামনেই। উনি আসতে করে ঊঠে পড়লেন ট্রেনে। উনার পিছু পিছু বৃদ্ধা মহিলা ও ঊঠে পড়লেন। উনাদের সিট একই বগিতে পড়েছে। এবং যথারিতি সেই বগিতে আর কোন মানুষ জন নেই।

সিটে বসেই রাজু সাহেব বই টা ব্যাগে ঢুকিয়ে আসতে করে ঘুমিয়ে পড়বেন বলে মনস্থির করলেন। তিনি বই ব্যাগ গুছিয়ে বস্তে যাবেন এমন সময় স্টেশন মাষ্টারের রুমে বসে থাকা সেই পাগলি রাজু সাহেবের বগির বাইরে থেকে জানালা দিয়ে রাজু সাহেব কে চিৎকার করে বলতে লাগল-

“ঐ তুই যাইসনা এই ট্রেন এ। এই ট্রেন তোর লাইগা আহেনাই। এটা তোরে শেষ কইরা দিব। তুই যাইস না- অমঙ্গল হইব- ঘোর অমঙ্গল”

চিৎকার করে বলতে বলতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। রাজু সাহেব মনে মনে পাগলের প্রলাপ মনে করে হেসে ব্যাগ টা মাথার উপর র্যাদকে রেখে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। ততক্ষনে ট্রেনের গতি পেরিয়ে গেল লাকসাম স্টেশন।

কিন্তু একটা গুন গুন শব্দে রাজু সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেল।তিনি গলা বাড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন উনার বগি থেমে আছে। ট্রেন চলছে না। চারদিকে প্রচন্ড বাতাসে শো শো শব্দ হচ্ছে।এই শব্দে উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি উঠে বাইরে যাওয়ার গেট এর দিকে গেলেন। অনেক কষ্টে সেই গেট খুলে যা দেখলেন উনার তাতে হার্ট বিট বেড়ে গেল কয়েকগুণ।দেখলেন উনার বগির কোন দিকেই কোন বগি নেই। উনি হয়ত খেয়াল করেন নি- যে উনি শেষ বগি তে ঊঠেছিলেন। এবং চলতি পথে কোন ভাবে উনার বগির সাথে মূল ট্রেনের সংযোগ ছিড়ে গেছে। ভাবতেই উনি ঘেমে গেলেন। কেউ নেই চারপাশে। সুনসান নিরবতা। এমন কি বগিতেও কেই নেই। চারদিকে ফাঁকা একটা যায়গায় তিনি একা একটা ট্রেনের বগিতে- চিন্তা করতেই উনার ঘাড়ের বাম পাশে ব্যাথা করতে লাগল।উনার কয়েক বছর ধরে হাই প্রেশার। উনি বুঝতেই পারলেন না উনি কি করবেন। মাথার উপর আকাশ ছাড়া কিছুই তিনি ভালভাবে খেয়াল করতে পারছেন না। বগিতেও বসে থাকতে পারছেন না। অন্ধকার বগি- বাইরে ঝড়। এবং এমন সময় হটাত করে ঝড় থেমে গেল।

উনি এবার সত্যি ভয় পেয়ে গেলেন। এবং ঠিক সেই সময় খুট করে একটা শব্দ হল। শব্দটা এসেছে বগির পেছন দিক থেকে। উনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেখানের বিপরিত দিক থেকে। তিনি ভালভাবে খেয়াল করতে চেষ্টা করলেন। দেখলেন সেই ঘোমটা পড়া বৃদ্ধা এসে সামনে দাঁড়াল উনার। এবং উনার গলা চেপে ধরল প্রচন্ড শক্তিতে///

এক ঝটকায় উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিলেন। বইটা কোলের উপর রেখে ই তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। চারপাশে সেই কোলাহল শুনে শরীরে কিছুটা শক্তি পেলেন। তারপর দেখলেন উনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সিলেটগামী ট্রেন। উনার বগি নাম্বার “ট”।

উনি দেরি না করে ঊঠে বসলেন উনার বগিতে। উনার জিনিস পত্র গুছিয়ে নিতে নিতেই তিনি একটা চিৎকার শুনতে পেলেন বাইরে। কোত্থেকে একটা পাগলি এসে চিৎকার করে বলতে লাগল-

“ঐ তুই যাইসনা এই ট্রেন এ। এই ট্রেন তোর লাইগা আহেনাই। এটা তোরে শেষ কইরা দিব। তুই যাইস না- অমঙ্গল হইব- ঘোর অমঙ্গল”

তিনি স্বপ্নের সাথে মিলাতে মিলাতে ট্রেন ছেড়ে দিল।উঠে জিজ্ঞাসা করবেন ভাবছিলেন পাগলিকে।কিন্তু ট্রেন ছেড়ে দেয়ায় তিনি পাগলি কে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি এসে তার সিটে বসতে গিয়ে ই হটাত খেয়াল করলেন- পুরো বগি খালি –কিন্তু একদম শেষে দিকে একটা কাথা মুড়ি দিয়ে কেউ একজন বসে আছে এবং তিনি সিট পেয়েছেন একদম শেষ বগিতে। উনার বগির পরে আর কোন বগি নেই ......

( সমাপ্ত )

পুঁথি.......................................**********.......ছোট রহস্য গল্প

পুঁথি ২৩-০৭-০৭
পুঁথিটা পাবার পর জীবনটা আমার নতুন দিকে মোড় নিয়েছে।আপন মানুষেরা দূরে সরে গেছে ধীরে ধীরে। আমি হয়ে ঊথেছি ক্ষমতাবান। বিয়ে করা হয়নি- করলে হয়ত বউটাকে হারাতে হত।
মা অসুস্থ- পায়ে বাতের ব্যাথা-প্যারালাইসিস। আগে প্রতিদিন মায়ের পায়ের কাছে বসে হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিতাম। এখন মাকে ডাইনি বলে মনে হয়। হটাত হটাত ইচ্ছে করে গোলা টিপে মেরে ফেলি।বাবা নেই আমার- থাকলে হয়ত আমার হাতেই মারা যেতেন।
আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ নেই। সবাই একে একে আমাকে ছেড়ে চলেগেছে। কাকা জ্যাঠারা সবাই একে কে মারা গেছে চোখের সামনে। আমি চেয়ে চেয়েদেখেছি। আপন বলতে আছে আমার মা- আর দূর সম্পর্কের এক বোন। আর আমাদের দেখাশোনা করার জন্য এক কাজের মেয়ে এবং আমার এই পুঁথি।
কি? বুঝতে পারছেন না? আ,আর একটা পুরনো আমলের পুঁথি আছে।
অনেক পুরানো একটা পুঁথি। আজ থেকে মাস ছয়েক আগে পেয়েছিলাম। এখন আমার এই পুথিটাই আমার সব।আশ্চর্য আজব এই পুঁথি। অনেক অনেক পুরনো। হয়ত হাজার বছরের ও আগের। হয়ত কোন এক বড় পুথির অংশবিশেষ। আমি অবশ্য সে সব নিয়ে মাথা ঘামাইনা। আমার শুধু পুঁথি হলেই চলে- সেটা যে নরক থেকেই আসুক না কেন।কি? আমাকে পাগল মনে হচ্ছে? ভাবছেন এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লেন?
মা কালীর কিরে কেটে বলছি, আমার একটা পুঁথি আছে- এবং এটাই আমার জীবন পরিবর্তন করে দিয়েছে। আচ্ছা-বলছি সব......
আমাদের গ্রামের একদম শেষে আমাদের চৌধুরী বাড়ি। অনেক কাল আগে আমরা জমিদার ছিলাম। কোন এক অজ্ঞাত কারনে আমার ঠাকুরদাদার বাবা বড়দা চরণ চৌধুরী গায়েব হয়ে যাবার পর আমাদের জমিদারি শেষ হয়ে যায়। জমি জমা সব আশেপাশের লোকজন দখল করে নেয়। প্রভাব প্রতিপত্তি যা- সব এই জমিদারবাড়ির ভেতরে এসে ঠেকে।
অবশ্য এখন ও আমাদের কথার মুল্য দেয় দশ গ্রামের মানুষ- তবে পেছন ফিরলেই গালিও দেয় অনেকে। যে লোকগুলো বড়দা চরণ চৌধুরীকে দেখলে মাথা নুইয়ে রাখত- তাদের ছেলে মেয়েরা এখন আমি রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী কে দেখলে উঠে নমষ্কার পর্যন্ত দেয়না।অবশ্য দেবেই বা কেন- এখন তো আবার গণতন্ত্র- সবার সমান অধিকার- কিন্তু সমান অধিকার দিয়েই হল যত যন্ত্রনা- কেউ কারো কথা শোনেনা- সবাই আমাদের জমিজমা দখল করে বাড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করল। কি আর করা- আমাকে ও মেনে নিতে হল তাদের রায়। আমার পরদাদা বড়দা চরণ চৌধুরী ই সুদুর বার্মা থেকে অনেক গুলো দুর্লভ বইয়ের সাথে এই পুঁথিটা নিয়ে আসেন। কালের অতলে হারিয়ে গেছে যার অনেক গুলো পাতা।
বড়দা চরণ চৌধুরী হটাত করে ষাট বছর বয়সে অদৃশ্য হয়ে গেলে আমাদের অবস্থা হয় শোচনীয়। দাদু শচিন্দ্রলাল চৌধুরী কোন রকমে গ্রাম ডাক্তারি করে সংসার চালাতেন। আমার বাবা সেটা ও পারেন নি। বলা বাহুল্য বাবা এজন্য আমাদের আত্মীয় স্বজন দের দায়ী করেন- যারা নিজেদের মাঝে জমিজমা ভাগ করে নেবার সময় নিরীহ বাবাকে ছিটে ফোটা ও দেয়নি।

বাবা কিছু না পেলে ও আমি কিন্তু ঠিক পেয়েছি। এই যে অমুল্য এই পুঁথিটা – যেটা আমাকে করেছে অমিত শক্তির আঁধার। জীবনের মোড় আমার ঘুড়িয়ে দিয়েছে অন্য দিকে। পুথিতে লেখা আছে আশ্চর্য সব কথা। এসব কথা প্রকাশ করা বারন- তাই লিখলাম না- তবে এই কথা গুলোই অমিত শক্তির উৎস।

এই পুঁথিটা লেখা হয়েছে অনেক পুরানো বাংলা ভাষায়- একার আকার নাই। অনেক কষ্টে আমি এটা থেকে বাংলা উদ্ধার করি। আর সেটা পড়েই আমি অভিভুত হয়ে যাই।
লেখা আছে বন্ধ ঘরে একটা কালো মোরগের মাথা ছিড়ে কাপালাক্ষি মন্ত্র পড়তে পড়তে সেই তাজা রক্ত খেলে কোন দিন খিদে লাগবেনা।
খিদে না লাগলে তো কাজ ও করতে হবেনা- এই ভেবে অলস আমি অনেক কষ্টে একটা খালি ঘর বের করে জঞ্জাল পরিষ্কার করে সেখানে একটা কালো মোরগের মাথা একটানে ছিড়ে কাপালাক্ষি মন্ত্র তিনবার পড়ে গরম গরম রক্ত মুখের কাছে এনে ঢক ঢক করে খেয়ে নিলাম কিছুটা- কিন্তু এর পড়েই ঘটল অঘটন- হটাত তীব্র বেগে আমি আমার নিজের শরীরের উপরে বমি করে দিলাম।
বিফল মনোরথে আমি ফিরে গেলাম নিজের ঘরে। ভালমত শরীর ধুয়ে ও সেই রক্তের বিটকেলে গন্ধ টা গেল না। রাতে খাওয়া দাওয়া করার পড়েই পেটে আমার কেমন যেন করতে শুরু করল। মনে হল পেটে আমার কিছু একটা নড়াচড়া শুরু করেছে। আমি কিছু হবেনা ভেবে যেই এক গ্লাস গরম দুধ খেতে যাব তখনি বুঝলাম পেটের ভেতর আমার কোন কিছু একটা নড়া চড়া করছে। আমি ভয়ে দুগ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। পানি পেয়ে জিনিসটা আরও বেশি ফুলে ফেঁপে উঠল। আর আমি হাটলেই আরও দ্বিগুণ গতিতে নড়াচড়া করতে লাগলো। আমি ভয় পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম।
দুদিন পর আমার সেই দুঃসম্পর্কের বোন আমাকে ডাক্তার বদ্যি দেখিয়ে যখন সুস্থ করে তুলল-এর মাঝে আমাকে অনেক কিছু খাওয়াতে চেয়েছে। আমি নাকি খাইনি কিছু। এবং এর পরদিন ও আমি কিছু খাবার কোন অনুভুতি না পাওয়ার পর বুঝতে পারলাম আমার খিদে নাই হয়ে গেছে।
সমস্যার শুরু সেই দিন থেকেই। আমার প্রচন্ড তৃষ্ণা পেতে লাগলো। আমি গ্লাসের পর গ্লাস পানি খেয়ে গেলাম। পানি খেলাম কিন্তু শরীর থেকে এক ফোটা ও পানি বের হলনা। ফলাফল হল আমার হাত পা ফুলে ঊঠল।আমি রীতিমত অসুস্থ হয়ে গেলাম।আর সমাধান খুঁজে পেলাম সেই পুঁথির তিন নম্বর পাতায়। এক অক্ষত যোনির কুমারি কন্যার হৃদপিন্ডের তাজা রক্ত খেতে হবে। তাহলেই পরিত্রান।
আর এর সমাধান ও দিল আমার খুব কাছের সেই দুঃসম্পর্কের বোন। ওর সাথে শুধু শুধু খারাপ ব্যাবহার করলাম। মাকে এটা সেটা বুঝিয়ে ওকে মামা বাড়িতে দিয়ে আসব বলে ওকে নিয়ে রওনা হলাম। এবং ওকে সেখানে না নিয়ে গিয়ে এক নির্জন নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে হত্যা করলাম। বুক চিড়ে হৃদপিন্ড টা কেটে নিয়ে লাশটা ভাসিয়ে দিলাম নদীতে। তারপর সেখানে বসেই সন্ধিপনি মন্ত্র পড়ে খেয়ে ফেললাম সবটুকু রক্ত।এবার কোন সমস্যা হলনা। মানিয়ে নিলাম নিজেকে। বেঁচে থাকার জন্য এটা আমার খুব দরকার ছিল।
তারপর থেকে আমি কিছু না খেয়েই বেঁচে রইলাম । আমাকে কিছু খেতে হয়না। এরপর আমি কতকিছু খেলাম।গায়ে গতরে আমি খাটো ছিলাম বলে লম্বা হবার জন্য খেলাম ইদুরের রক্ত। স্বাস্থ্য ফিরে পাবার জন্য কালো বেড়ালের লেজের রক্ত, মাথার চুল গজাবার জন্য গুইসাপের চোখ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

শুধু রূপ নয়- ধন দৌলত ও দিতে পারে এই পুঁথি। পুথিতে লেখা একটা মিত্রবিশবা শ্লোক আমি তিনদিন লাল মাটি গায়ে মেখে পানিতে নেমে পূর্বমুখি হয়ে তিন লক্ষ বার পড়তেই আমি ফিরে পেলাম আমার পরদাদার আমলে হারিয়ে যাওয়া একশোটা সোনার মোহর।
মানুষকে বশ করার জন্য মরা গরুর পচে যাওয়া ভাড়াল চিবিয়ে খেতেই আমি ফিরে পেতে শুরু করলাম আমার হারানো প্রতিপত্তি। আমার কথা যারা কোনদিন শুনতোনা তারা এখন আমাকে দেখলেই সম্মোহিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু আজ আমি এক অনন্য ক্ষমতা লাভ করব।আজ আমি অদৃশ্য হব। সত্যি বলছি আমি আজ দেহ শুন্য হব। ফলে আমি যে কোন স্থানে চলে যেতে পারবো নিমিষেই। আমি মাতাল নই- পাগল নই- আমি বলছি আমি আজ পুরোপুরি স্বাধীন হব।আমি আজ অদৃশ্য হব- আমি হব সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী......
কাজটাতে একটু ঝুকি আছে। যদিও আমি ধর্মে বিশ্বাস করিনা- কিন্তু একলা একলা মন্দিরে যেতে ভয় পাই। কারণটা নাইবা জানলেন। আমাকে একটা মানুষের মাথার খুলি জোগাড় করতে হবে। তারপর একটা নির্জন কালী মন্দিরের পেছনে গিয়ে অমাবস্যা রাতে ভোর হবার আগে একটা চিদাম্ব্রম মন্ত্র দশলক্ষবার জপ করতে হবে।
আমাকে এখন যেতে হবে। আমাকে দেখতে না পেলে ও আশা করি এই লেখা খাতাটা আর এই পুঁথিটা আপনারা পাবেন। অবশেষে বিদায়- ভাল থাকবেন সবাই- ইতি- রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী

* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *

চিঠিটা চিলেকোঠায় পেয়ে একনিমিষে পড়ে ফেলে সৈকত। বাবাকে সেটা দেখাতেই সৈকতের বাবা সেটাকে গাজাখুড়ি বলে ঊড়িয়ে দিলেন। বললেন- ঐ রাজেন্দ্র বেচারা পাগল হয়ে গিয়েছিল মাঝ বয়সে এসে।অভাবে পাগল হয়ে যাওয়া সেই রাজেন্দ্র পাগল হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। ওদের পুরনো জমিদার বাড়িটায় কোন কিছু পাওয়া যায়নি। পুঁথি একটা ছিল বটে তবে সেটা এখন জাতীয় জাদুঘরে শোভা বাড়াচ্ছে।শুনে সৈকত ব্যাপারটা নিয়ে আর ঘাটায় না।

এর ঠিক একবছর পর সৈকতদের স্কুল থেকে শাহবাগ জাতীয় গাদুঘরে ওদের শিক্ষাসফরে নিয়ে যাওয়া হল। কাঁচের বাক্সের আড়ালে এটা সেটা দেখতে সামনে একটা পুঁথি দেখতে পেল সে।পুঁথির নিচে সেই জমিদার বাড়ি আর সেই চৌধুরী পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা ছিল। সৈকত বুঝল এটা সেই পুঁথি যেটা পড়ে রাজেন্দ্র নামে সেই পাগল লোকটা অনেক ক্ষমতা পেয়েছিল।অনেক কষ্টে লুকিয়ে সেটার ছবি তুলে নিল সে তার মুঠোফোনে। তারপর বাসায় প্রিন্টার থেকে ছবিটা প্রিন্টআঊট নিল। তারপর সেই পাতায় লেখা অনুযায়ী একটা টিকটিকি ধরে লেজ ফেলে দিয়ে পুড়িয়ে মুখে পুড়ে দিল সে।তারপর সেই পাতায় লেখা মন্ত্রটা তিনবার পড়তেই অজ্ঞান হয়ে গেল সৈকত।
****************************
এখন সৈকত হাসপাতালের কেবিনে শুয়ে আছে। আর শুয়ে শুয়েই সে ডাক্তারের মনের কথা শুনতে পারছে। প্রথম মনে করেছিল মনের ভুল- কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারল- তার চোখ যার দিকেই পড়ছে তারই মনের কথা বুঝতে পারছে সে। মনে মনে একচোট হেসে নিল সৈকত- তারপর আপন মনেই বলল-
যা পেয়েছি- সেই ক্ষমতাতেই সারা জীবন কেটে যাবে-আর কোন দিন আমি সেই পুঁথি মুখো হবোনা- বলেই মনে মনে একচোট হেসে দিল- আর সামনে থাকা নার্সের মনের কথা শুনে ফেলল বেচারা- নার্স মনে মনে বলছেন-“ছেলেটা পাগল নাকি? মনে মনে হাসছে কেন?”
শুনেই হাসি থামিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল সৈকত -ওর যে এই ক্ষমতা আছে সেটা কেঊকে বুঝতে দেয়া চলবে না.....

    Definition List

    Text Widget