ভৌতিক গল্প :সাত


কালো মানুষ   



দাঁড়কাক ও অন্ধ ভিখারি

স্কুলে যাওয়ার মুহুর্তে রনি বললো, মা, শরীরটা কেমন যেন লাগছে। আজকে স্কুলে যাবো না।
জুতো-মোজা, জামা-প্যান্ট পরে স্কুল ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরুবার মুহুর্তে ছেলের মুখে এ কথা শুনে একটু অবাক হন ইলোরা রহমান, রনির মা।
সমস্যা কী?
মা, আমার শরীরটা কেমন যেন করছে, বমি বমি লাগছে।
কাছে এসে ছেলের কপালে হাত রাখেন। নাহ্, জ্বর নেই। তার পরও রিস্ক নিলেন না।
ঠিক আছে, বাসায় রেস্ট নাও। স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। আর সারা দিন কম্পিউটারের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকবে না। ঠিকঠাক মতো খাওয়া-দাওয়া করবে। বুয়াকে বলে যাচ্ছি, সে খেয়াল রাখবে।
দিনের শুরুর এই মুহর্তটিকে দম ফেলার সময় থাকে না মায়ের। ছেলের স্কুল, নিজে তৈরি হওয়া, রনির বাবার অফিসের তাড়া, বুয়ার সারাদিনের কাজের ফর্দ বলে যাওয়া- সব মিলিয়ে সময় ম্যানেজ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই যেমন এখন বেডরুম থেকে বাবার গলা পাওয়া যাচ্ছে, যথারীতি চশমা খুঁজে পাচ্ছেন না। প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, সকাল বেলায় নানা ধরনের উদ্ভট সব ঝামেলা এসে ভিড় করে। তাই রনি পরতপক্ষে এ সময় মা-বাবার সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে না। দরকারি কথাগুলো রাতেই সেরে নেয়। জানে, সকালে হৈহট্টগোলের মধ্যে আলাপের সুযোগ নেই।
হন্তদন্ত হয়ে রুমে ঢোকে বাবা। বেশ অবাক হয় রনি। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ কওে বলে সকালে উঠকে বেশ কষ্ট হয় বাবার। আর এ জন্য প্রতিদিন একেবারে শেষ মুহুর্তে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে কাপড় পরেই অফিসে ছুটতে হয় তাকে। সকালে কারো দিকে তাকানোর সময় পর্যন্ত থাকে না বাবার হাতে। তাই এই সকাল বেলা নিজের রুমে বাবাকে দেখে রনি অবাক।
কিরে, তোর নাকি শরীর খারাপ। মাঝে মাঝে অবশ্য এমন শরীর খারাপ হওয়াটা শরীরের জন্যই ভালো। স্কুলে যেতে হয়না, সারা দিন বাসায় থাকা যায়, ইচ্ছে মতো গল্পের বই, কম্পিউটার গেমস...কত্তো মজা।
চোখ মটকে বলেন বাবা।
যাও, আমি কী সেরকম নাকি?
একটু হেসে চলে যান বাবা।
শহরের একটি নামকরা স্কুলে পড়ে রনি। উপস্থিতির ব্যপারে এখানে ভীষণ কড়াকড়ি। রনিও পারতপক্ষে স্কুল মিস দেয় না। স্কুলে যেতে সে পছন্দই করে। আর স্কুলে না গেলে প্রাণের বন্ধু রেশাদের সঙ্গেও দেখা হওয়ার চান্স নেই। রেশাদ যা মজার মজার কৌতুক জানে, শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। ইউনিভার্সিটি পড়–য়া ছোট মামা রেশাদদের সঙ্গেই থাকেন, তার কাছ থেকেই এসব কৌতুক আর গল্প শোনে রেশাদ। ওকে স্কুলে না দেখে নিশ্চই খুব অবাক হবে রেশাদ।
ক্লাস সিক্সে পড়া অন্য ছেলেদের চেয়ে রনি অনেক বেশি গোছানো। রাতেই স্কুল ব্যাগ, জামা-জুতো সব গুছিয়ে রাখে। রনির ঘরটিও সব সময় করে গোছানো থাকে। কাল রাতে শুতে যাওয়ার সময় থেকেই একটু অস্বস্তি লাগছিলো। পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিলো সকালে ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক ছিলোও, কিন্তু বেরুবার মুহুর্তে হঠাৎ মনে হলো শরীরটা ঠিক সুবিধার ঠেকছে না।
বাবা-মা বের হয়ে যাওয়ার পর কম্পিউটার খুলে বসে রনি। কিছুক্ষণ পর উঠে পড়ে। কেন একটা অস্বস্তিবোধ তাড়া করছে, অস্থির লাগছে। হয়তো স্কুলে যায়নি বলেই অস্বস্তি লাগছে। একটু পর ল্যান্ড ফোনে ফোন করে মা।
এখন শরীর কেমন লাগছে বাবা?
ভালো।
কম্পিউটারের সামনে বেশিক্ষণ বসবে না, কার্টুন ছেড়ে বসে থাকবে না। রেস্ট নাও কেমন?
ওকে আম্মু।
রিসিভারটা নামানোর সঙ্গে সঙ্গেই আবার রিং হয়। টেলিফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে আসে বাবার কন্ঠ, রনি, সব কিছু ঠিক আছে তো?
শরীর একটু খারাপ লাগছিলো, এখন ঠিক আছে।
অফিস থেকে ফেরার সময় তোর জন্য কী নিয়ে আসবো?
উমমম, কুপারসের প্রেস্ট্রি।
ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস।
ফোন নামিয়ে রেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে রনি।
আজকে সব কিছুই কেমন যেন অন্যরকম লাগছে। ভেতরে কোথাও একটা দারুণ অস্বস্তি দানা বাঁধছে। বুকটা কাঁপছে। হঠাতই রনির মনে পড়ে যায়, কাল সারা রাত একের পর এক দুঃস্বপ্ন দেখেছে। কি আশ্চর্য, এতোক্ষণ এই দুঃস্বপ্নের কথা মনেই ছিলো না। সারাটা রাত অমানুষিক উৎকন্ঠা আর উদ্বেগে কেটেছে। কিন্তু একবারের জন্যও ঘুম ভাঙ্গেনি। ঘুমের মধ্যেই রনি বুঝতে পারছিলো, এগুলো সব দুঃস্বপ্ন, বাস্তব নয়। বার বার স্বপ্ন ভাঙ্গার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠতে চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু অদৃশ্য কোনো একটি শক্তি যেন জোর করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে। ভয়ঙ্কর এই স্বপ্নগুলোর প্রতিটিই যেন দেখতে বাধ্য হয় রনি, সেটি নিশ্চিত করতে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছে কেউ একজন।
জানালার বাইরে ঝকঝকে দিনের আলো।
নীচে রাস্তায় ফেরিওয়ালার হাঁক শোনা যাচ্ছে। রান্নাঘার থেকে ভেসে আসছে বুয়ার থালা-বাসন মাজার শব্দ। আশপাশের কোনো এক বাসায় চড়া ভলিউমে হিন্দি গান বাজছে। চারদিকে সবকিছু ঠিকঠাক নিয়ম মতো চলছে। আগস্ট মাসের গুমোট গরমেও নিজের রুমে বসে শীতে কাঁপতে থাকে রনি। হাতের তালু আর পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
মনে হয় জ্বর আসছে। বেড কভারটি দিয়ে গা ঢেকে বিছানায় শুয়ে পড়ে রনি। টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে আনন্দমেলার পূজা সংখ্যাটি নেয়। দু-এক পাতা শেষ করার আগেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে রনি।
রান্না ঘওে থালা-বাসন পরিষ্কার করে দুপুরের ভাত চড়ায় আমেনা বুয়া। তখনই তার রনির কথা মনে পড়ে। অফিসে যাওয়ার আগে বিবিসাব তাকে বলে গেছে রনির দিকে খেয়াল রাখতে।
হুহ, অতবড় ডাঙ্গর পোলা তার দিকে আবার খিয়াল রাখতে হইবো। আমার তিন বৎসরের মনিররে যে বস্তিত থুইয়া কামে আহি, তারে কে দ্যাহে?
নিজের মনে গজগজ করতে করতে রনির রুমে ঢোকে বুয়া। বিছানার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে। এই তালপাকা গরমের মধ্যে চাদরমুড়ি দিয়ে বেহুসের মতো ঘুমিয়ে আছে রনি। সারা মুখ, চুল ঘামে ভিজে একাকার। হাঁপানির রোগির মতো জোওে জোওে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বুকটা উঠানামা করছে হাপড়ের মতো। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে গায়ে জড়ানো চাদরটিও উঠছে-নামছে।
রনির গায়ে ঝাকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোর চেষ্টা করে আমেনা বুয়া। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর টকটকে লাল চোখ মেলে চায় রনি। এই দৃষ্টির সামনে কুঁচকে যায় বুয়া। তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কেউ একজন আলতাগোলা পানি ঢেলে দিয়েছে চোখ দুটোতে। টলতে টলতে বাথরুমে ঢোকে রনি।
রান্না ঘরে পিড়িতে বসে ভাবতে থাকে আমেনা। রনির অবস্থা দেখেতো মনে হচ্ছে শরীর বেশ খারাপ। রনির বাবা-মা দুজনার অফিসের ফোন নম্বরই আছে তার কাছে। রনিকে বললেও ফোন করে দেবে। কিন্তু ফোন করবে কি না, সে ব্যপারে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না আমেনা।
বাথরুম থেকে বের হয়ে আসা রনিকে দেখে স্বস্তিও নিঃশ্বাস ফেলে আমেনা। এখন রনিরও অনেক সুস্থ্য লাগছে। ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে। ভাত হতে দেরি হবে, তাই ফ্রুট বাস্কেট থেকে একটা আপেল তুলে নেয় রনি। লিভিং রুমে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখতে আপেলে কামড় বসায়। সঙ্গে সঙ্গেই মুখ বিকৃত করে থুথু করে আপেলের টুকরোটি মুখ থেকে বের করে দেয়।
পুরো মুখ বিস্বাদ হয়ে আছে। আপেল নয়, যেন আস্ত একটা কাঁচা করলায় কামড় বসিয়েছে। এমন তিতা লাগছে। অথচ আপেল রনির খুব প্রিয়। শব্দ শুনে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে আসে আমেনা। তার সামনেই কারপেট ভাসিয়ে দিয়ে হড়হড় করে বমি করে দেয় রনি।
রনির বেডরুম ঘেঁসে যে ঝাকড়া আমগাছটি সেটার ডালে এতোক্ষণ ধরে স্থির হয়ে বসে ছিলো একটা বড় কালো দাঁড় কাক। কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। ঘরের ভেতর যখন আমেনা বুয়া রনিকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন দাঁড় কাকটি মাথা ঘুরিয়ে নীচে রাস্তার মোড়ের দিকে তাকায়। সেখানে বসে থাকা অন্ধ ভিখারিটিও মাথা উঁচু করে দাঁড়কাকটির দিকে নজর ফেরায়। নিঃশব্দে কিছু তথ্যের আদান-প্রদান চলে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলা লোকজনের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, এই মুহুর্তে একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনার প্রথম ধাপটি পূর্ণ হলো।
খুব নজর দিয়ে লক্ষ্য করলে স্থানীয় বাসিন্দারা খেয়াল করতো, কদিন ধরে একটি অন্ধ ভিখারি রনিদের বাসা থেকে একটু দূরে রাস্তার মোড়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকছে। ভিখারিকে কেউ সেভাবে নজর করে না, সে জন্যই এই ভিখারিটির স্বভাবের বিচিত্র দিকগুলো কেউই খেয়াল করেনি। যেমন সারা দিন রাস্তায় বসে থাকলেও এই ভিখারি কারো কাছেই ভিক্ষা চায়নি। সে অন্ধ, বোবা নয়। বোবা হলেও থালা নেড়ে ভিক্ষা চাওয়াটাই স্বাভাবিক।
কালো দাঁড় কাকটি গত সাত দিন ধরে আস্তানা গেড়েছে রনিদের আম গাছটিতে। সারা দিন কোনো শব্দ নেই, কাকা করে ডাকাডাকি নেই, শুধু এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে রনির বেডরুমের দিকে তাকিয়ে থাকা। এটাই ছিলো তার কাজ।
বড় দুটি ডানা ঝাপটে গাছের ডাল ছাড়ে দাঁড়কাকটি। ছেড়া কাপড়টি ফেলে উঠে দাঁড়ায় অন্ধ ভিখারি। আস্তে আস্তে হেঁটে চলে যায়। তার মাথার উপর উড়তে থাকে গড়পড়তা কাকগুলোর চেয়ে আকারে বেশ বড় একটি কুচকুচে কালো দাঁড়কাক।
দেখে মনে হয়, তাদের অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে।
এবার বাড়ি ফেরার পালা।



ষড়যন্ত্রের দ্বিতীয় ধাপ

গ্যারেজে গাড়ি ঢোকানোর মুহুর্তে বিপত্তি।
কোত্থেকে একটা বেড়াল এসে দৌড়ে গাড়ির সামনে দিয়ে পার হলো। মনটা খারাপ হয়ে যায় ইদ্রিস মিয়ার। কিছু কিছু ব্যপার সে কঠিনভাবে মেনে চলে। যেমন ওস্তাদের কাছ থেকে শেখা, গাড়ির সামনে দিয়ে বেড়াল পার হলে তা অয়ানক অশুভ লক্ষণ। যতোক্ষণ না আরেকটা বেড়াল একইভাবে গাড়ির সামনে দিয়ে পার হচ্ছে, ততোক্ষণ গাড়ি চালানো নিরাপদ নয়।
কিন্তু ইদ্রিস মিয়ার বেড়ালের অপেক্ষায় বসে থাকার সময় নাই।
আলসারের রুগি সে। খালি পেটে থাকা যেমন বিপজ্জনক, তেমনি বাইরের খাবার খাওয়া ডাক্তারের কড়া নিষেধ। আর হোটেলের খাবার তার পেটেও সয়না। একজন ড্রাইভারের জন্য এটা বিরাট সমস্যা। পেটে আগুন জ্বলছে। জলদি গাড়ি গ্যারেজ কওে বাড়ি ফিরে আগে ভাত রাধতে হবে, তাপর খাওয়া।
জিপিওর একজন কেরানির কোয়ার্টারে একরুম নিয়ে সাবলেট থাকেন ইদ্রিস। বারান্দার এক চিলতে রান্না ঘরে বাড়িওয়ালার রান্না চলে, সেখানেই নিজের রান্না করেন ইদ্রিস। এই বাজারে ঢাকা শহরে পরিবার নিয়ে থাকা অসম্ভব। বউ-বাচ্চারা বাড়িতেই থাকে। মাসে-দুমাসে একবার গিয়ে তাদের দেখে আসেন, বউয়ের হাতে টাকা-পয়সা দিয়ে আসেন। একচিলতে জমিতে যেটুকু ফসল হয় তা দিয়ে কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে যায় ইদ্রিস পরিবারের।
অলুক্ষুনে বেড়ালটার কথা মনে করে ভেতরটা খচখচ করছে। গাড়ির দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরের লাইটটা নিভে যায়। অন্ধকারে ঘাড়ের চুলগুলোসব দাঁড়িয়ে যায়। তীব্রভাবে অনুভব করেন, অন্ধকারে কেউ তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ্য করছে। সঙ্গে সঙ্গে আবার বাতি জ্বালেন।
কই, কোথাওতো কেউ নেই! তাহলে কী মনের ভুল? তাই বা হয় কী করে, এতো জীবন্ত, এতো তীব্রভাবে অনুভব করলেন!
বেশি ভাববার সময় নেই। গাড়ি লক করে পা বাড়ান বাইরের দিকে।
এক ঝলক ঠান্ডা বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকান ইদ্রিস। ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে আকাশ। মাঝে মাঝে আকাশের বুক চিড়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যাক, আজ রাতে শান্তির ঘুম হবে। জিপিওর ফোর্থ ক্লাস এম্প­য়িদেও ঘুপচি কোয়ার্টারে গুমোট গরমে সারাটা রাত কেটে যায় গায়ের ঘাম মুছতে মুছতে। যখন বিদ্যুৎ থাকে না তখনতো কথাই নেই, আর যখন থাকে, তখন মাথার উপর শব্দ করে ফ্যানটা ঘুরে। এতে বাতাস না পাওয়া গেলেও ঘরে একটি ফ্যান আছে এবং সেটি ঘুরছে- এই মানষিক শান্তিটা পাওয়া যায়। তাই ভিজে যাওয়ার জোড়ালো আশঙ্কা স্বত্ত্বেও আসন্ন বৃষ্টির আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেন ইদ্রিস।
বড় বড় পা ফেলে হাঁটতে থাকেন। বৃষ্টি আগে শুরু হয় ধুলি ঝড়। চারদিক ধুলোয় ঝাপসা হয়ে উঠে। এই দুর্যোগের রাতে রাস্তা একেবারে সুনশান। ঝড়ের বেড় বাড়ছে। কড়াৎ শব্দে আশেপাশে কোথাও একটা গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়ে। এবার ছুটতে থাকেন ইদ্রিস।
একটু পর থমকে দাঁড়ান। ঝুলোর মেঘ ফুঁড়ে যেন উদয় হয়েছে যন্তুগুলো। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশালাকার তিনটি কালো কুকুর দেখে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। আবছা অন্ধকারে যেন পশুগুলোর চোখ জ্বলজ্বল করছে। তীক্ষè সাদা দছাতগুলো আবছা অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। প্রায় আধ হাত সমান বেরিয়ে থাকা জীবগুলো বেয়ে লালা ঝড়ছে। পুরো দৃশ্যটাতেই একটা কেমন গা গুলানো অশুভ ছায়া। শরীরের সবগুলো লোম দাঁড়িয়ে যায়। একপা-দুপা করে পেছাতে থাকেন ইদ্রিস। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুটি গুটি পায়ে আগাতে থাকে যন্তুগুলো। নির্মম স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এ সময় পেছন থেকে গড়গড় শব্দ। আস্তে আস্তে ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে সম্বিত হারিয়ে ফেলেন ইদ্রিস। পেছনে আরো দুটো এসে জুটেছে।
পালাবার পথ নেই।
সকল বিবেচনাবোধ হারিয়ে হঠাৎ দৌড়ানো শুরু করেন ইদ্রিস মিয়া। কয়েক কদম যাওয়ার পরই চাপা গর্জন করে তার টুটি লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্বাপদগুলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইদ্রিস। গলা বেয়ে গলগল করে রক্তের ধারা নামতে থাকে। এ সময় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামে। রক্তের ধারা ধুয়ে যায়। পাঁচটি কুকুর হঠাৎ বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠে। যেন জরুরি কোনো কথা মনে পড়েছে। পরষ্পরের সঙ্গে নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময় করে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে সেই অন্ধ ভিখারি।
এখন আর তাকে অন্ধ মনে হচ্ছে না। ইদ্রিসের প্যান্টের পকেট হাতড়ে ওয়ালেট, খুচরা টাকা বের করে নেয়। সার্টের বুক পকেটে পেয়ে যায় কাঙ্খিত বস্তুগুলো, গাড়ির চাবি আর সেল ফোন। এবার ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। ল্যাম্প পোস্টের ওপর বসে থাকা দাঁড় কাকটি বড় দুটি ডানা ঝাপটে পিছু নেয় তার।
রাতের ঝড়-বৃষ্টির বিন্দুমাত্র ছাপ নেই কোথাও।
চারদিক আলো করে রোদ উঠেছে।
শুক্রবারের অলস সকাল। সবার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব। রনিদের এই ফ্ল্যাট বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটি হচ্ছে মাস্টার বেডরুম লাগোয়া বারান্দাটি। মা নানা জাতের গাছ-টাছ লাগিয়ে এক্কেবারে দারুন সুন্দর করে তুলেছে। শুক্রবার সকালে এখানে বসে বড় একটা মগে কালো কফির সঙ্গে খবরের কাগজ পড়াটা ইফতেখার রহমান, মানে রনির বাবার ছুটির দিনের সবচেয়ে বড় বিনোদন।
কিন্তু আজ এই বিদোনটা নিরবিচ্ছন্নভাবে উপভোগ করা হলো না।
অনেকক্ষণ ধরে কে যেন বেল টিপছে। কেউ দরজা খুলছে না। অগত্যা নিজেকেই উঠতে হলো। অথচ, ছুটির দিনে পুরো পেপারটাই খুটিয়ে পড়ার অভ্যাস ইফতেখারের। এর মধ্যে কোনো কারণে উঠা পছন্দ করেন না। কিন্তু এভাবে বেল বাজতে থাকলে বসে থাকা যায়!
একটু বিরক্তি নিয়েই দরজা খুলেন। সিকিউরিটি গার্ডের সঙ্গে অচেনা এক লোক দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকাতেই অপরিচিত লোকটি বলতে থাকে,
স্যার, আমার নাম কিসমত। আপনাদের ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়ার শালা। ভাগ্নিটার শরীল খারাপ। তাই দুলাভাই কাল রাতের গাড়িতে বাড়ি চইলা গেছে। আমারে বলছে কয়েকদিন ডিউটি দিতে। আমার লাইসেন্স আছে স্যার। এই যে-
হড়বড় করে কথাগুলো বলে পকেট থেকে ড্রাইভার্স লাইসেন্স বের করে দেখায় কিসমত।
এবার একটু ভালো করে কিসমতের দিকে তাকান ইফতেখার। চিকন-চাকন গড়নের কিসমতের নাকের নীচে সরু গোফটা চেহারায় কেমন একটা চালাক চালাক ভাব ফুটিয়ে তুলেছে।
বয়স খুব বেশি নয়, বড়জোর ২৬-২৭। কিসমতকে ভেতরে নিয়ে আসেন ইফতেখার রহমান।
কতোদিন ধরে গাড়ি চালাও।
তা স্যার পাঁচ-ছয় বৎসর।
এর আগে কোথায় চাকরি করেছো?
স্যার চিটাগাংয়ে এক গার্মেন্টস মালিকের বাড়িতে কাজ করতাম। স্যার পুরা ফ্যামিলি নিয়া কানাডা চইলা গেছে।
ঠিক আছে। নীচে গিয়ে বসো।
একটু ভাবেন ইফতেখার, ইদ্রিস মিয়া একবার ফোনও করলো না। ঠিক সেই মুহুর্তে পাজামার পকেটে সেল ফোনটি কেঁপে উঠে। রাতের ঘুমটা নিরবিচ্ছিন্ন করতে মোবাইল ফোনের রিংগার অফ করে ভাইব্রেশনে দিয়ে রাখেন ইফতেখার।
পকেট থেকে ফোন বের কনে কানে লাগান। ইদ্রিস মিয়ার ফোন।
হ্যালো স্যার, ভোর সকালে শালা আইসা খবর দিলো ছুডু মাইয়ার শরীল খারাপ। সক্কালের গাড়িতেই বাড়ি আইলাম। শুক্কুরবার ছুডির দিন বইলা আমনেরে ফুন দেই নাই। আমার শালা কিসমতরে রাইখা গেলাম। হেয়ও ডেরাইবারির কাম জানে।
ঠিক আছে ইদ্রিস, মেয়ের খবর জানিও।
মনের কোনে যাও একটু দুশ্চিন্তা ছিলো, ইদ্রিসের ফোনটি পেয়ে সেটা কেটে গেল। দ্বিতীয় মগ কঠি নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ইংরেজি দৈনিকটা খুলে বসেন।
ফোনের অপর প্রান্তে কী ঘটছে সেটি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারতেন ইফতেখার সাহেব তাহলে এক্ষুনি একটা ছোটখাট হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো।
কথা বলা শেষে মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে পকেটে রাখে সেই অন্ধ ভিকারি। কাল রাতে ইদ্রিস মিয়ার মৃতদেহের পকেট থেকে এটা বের করে নিয়ে ছিলো। যন্ত্রটা এখন বেশ কাজে দিল। এটাকে যতœ করে রাখতে হবে। এতোদিন ধরে ইফতেখার সাহেবের
একটু পরেই এই ফোন থেকেই ইদ্রিস মিয়ার কন্ঠ নকল করে তার বাড়িতে ফোন করে। এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়িতে টাকা পাঠিয়ে দেবে, এ তথ্যটি জানিয়ে ইদ্রিসের স্ত্রীকে নিশ্চিন্ত করে।
যাক, দুই দিকই ঠিক আছে। এখন ইদ্রিসের নকল শালা কিসমত ধরা পড়ার আগেই ভালোয় ভালোয় কজটা শেষ করতে হবে। নিজের মনেই হেসে উঠে বহুরুপী অন্ধ ভিখারি। তার কাঁধে বসা দাঁড় কাকটাও কর্কস স্বরে ডেকে উঠে যেন সেও মালিকের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিল

0 comments:

Post a Comment

    Definition List

    Text Widget