ভৌ তিক গল্প : ছয়

কোব্বালা 

 



চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চমকে উঠে তন্ময়।
আগুন গরম চা।
তবে তার চমকে উঠার কারণ চায়ের উত্তাপ নয়, চাতো গরমই হবে। চমকে উঠে চায়ের স্বাদে। এই অজ পাড়া গাঁয়ের ছাপড়া চায়ের দোকানের চা যে এতোটা ভালো হবে তা ছিল কল্পনার অতীত। চায়ের কারিগরের দিকে দৃষ্টি ফেরায় তন্ময়। পরণের সার্টটি পুরোনো হলেও বেশ পরিষ্কার করে কাচা। প্রচন্ড গরমে আমি দর দর করে ঘামছি, অথচ এই লোক দিব্যি চুলোর পাশে বসে চা বানাচ্ছে। চোখে-মুখে বিরক্তির কোনো চিহ্ণই নেই। শরীরে নেই এক ফোটা ঘামের আভাস।
চমৎকার চায়ের স্বাদ নিতে নিতে তন্ময়ের মনের সকল বিরক্তি ধীরে ধীরে কেটে যেতে থাকে। বিরক্ত হওয়ার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ হাইওয়ের পাশে এই ছাপড়া দোকানে সে বসে আছে ঝাড়া একঘন্টা ধরে। তাকে নিতে যার আসার কথা তার কোনো পাত্তা নাই। বার বার মোবাইলে ফোন করে শুনতে পাচ্ছে-সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে গরমে জান ভাজা ভাজা।
তন্ময়ের আমেরিকা প্রবাসী মামার শখ হয়েছে গাজীপুরে কিছু জমি কিনে বাগান বাড়ি বানাবেন। সেই জমি দেখতেই আসা। কিন্তু জমির দালাল দোলোয়ারের কোনো পাত্তা নাই। অথচ কাল রাতেও কথা হয়েছে বাঘের বাজার বাস স্ট্যান্ডে সে আমার জন্য মোটর সাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করবে। মোটর সাইকেল তো দূরের কথা, কোনো সাইকেলেরও দেখা নেই।
কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখে। আর পনের মিনিট; এর মধ্যে দেলোয়ার না এলে টাটা বাইবাই। এর মধ্যে আর থাকবে না তন্ময়।
সময় কাটানোর জন্য চায়ের দোকানীর সঙ্গে আলাপ জুরে দেয়।
'ভাই কী এই এলাকার মানুষ?'
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় দোকানী।
'তাহলে তো আপনি দেলোয়ারকে চিনেন?'
এবারও ইতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। বোঝা গেল চা বিক্রেতা আলোচনায় আগ্রহী নয়। সময়তো কাটাতে হবে! তাই চা বিক্রেতার নিরু]সাহ উপেক্ষা করে একতরফা আলাপ চালিয়ে যায় তন্ময়।
'আমাকে নিতে তার আসার কথা, আর মোবাইলও বন্ধ।'
এবার তার দিকে চোখ তুলে তাকায় চা বিক্রেতা।
'দেলোয়ারের তো হুন্ডা একছিডেন হইছে। হেয় আইতে পারবো না।'
খবরটা শুনে চমকে উঠে তন্ময়। ওহহো, তাহলে তো বসে থেকে লাভ নেই। পরের বাস লোকাল হোক আর সরাসরি হোক, সেটাই ধরতে হবে। লোকাল হলে গাজীপুর গিয়ে বাস বদলে নিলেই হবে।
আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ায়। মানিব্যাগ বের করে চায়ের দাম চুকায়। খুচরা টাকা ফেরত দিতে দিতে চায়ের দোকানী বলে
'ভাইজান কী ঢাকা থাকেন?'
'হ্যা'
'অখনই চইলা যাইবেন?'
তার প্রশ্নে একটু অবাক হয় তন্ময়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আলটপকা এই প্রশ্নের জন্যই হয়তো একটু লজ্জিত বোধ করে দোকানী। দাঁত বের করে একটু বিব্রত হাসি দিয়ে বলে,
'আপনের হাতে সময় থাকলে একটু বসেন।'
'কেন কিছু বলতে চান আমাকে?'
এবার বেশ অবাক হয় তন্ময়। জানা নেই শোনা নেই এই চায়ের দোকানীর কী কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে? সেই সঙ্গে বেশ একটু কৌতুহলও বোধ করে। শোনাই যাক না কী বলতে চায় এই অপরিচিত দোকানী! আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে জুত হয়ে বসে।
'বলেন কী কথা।' বেশ উদার ভঙ্গীতে বলে। 'সবার আগে আপনার নামটা বলেন। নাম জানা না থাকলে আলাপ করে আরাম পাই না।'
'আলম।'
এক কথায় আমার প্রশ্নের জবাব দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে আলম। মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে নেয়। কিংবা গল্পটি কোথা থেকে শুরু করবে তা ঠিক করে নেয়। একটু পর গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করে।
'সে আমার লগেই থাকে। তিন বছর ধইরা আছে। তার ডরে আমি রাইতে কুনু খানে যাইবার পারিনা। দেখেন, আশে পাশের দুকানে কাস্টমারের ভিড়, কিন্তু আমার দুকানে একখান মাছিও বয় না। গেরামের লুকজন আমার লগে মিশে না। আমি বাই এক রকম এক ঘইরা।'
আলমের কথার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে আশপাশের দোকানগুলোতে সত্যি অনেক গ্রাহক, আর আলমের দোকানে আমি একা। কিন্তু এতেও কিছু পরিষ্কার হলো না। তন্ময়ের অবস্থা আঁচ করেই আলম গোড়া থেকে তার গল্পটি বলতে শুরু করে। তার কাছ থেকে শোনা ঘটনাটির সারাংশ হচ্ছে-
তিন বছর আগে পৌষ মাসে খালুর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে বাগেরহাটের খোন্তাকাটায় যায় আলম। সেখানে গিয়ে জানতে পারে একটি বাড়িতে প্রতি বুধবার জ্বীন নামানো হয়। সেই জ্বীন মানুষের রোগ-শোকের নিদান দেওয়া ছাড়াও প্রেমে ব্যর্থতা, আর্থিক উন্নতি, পরীক্ষায় পাশ, হারানো স্বজনকে খুঁজে দেওয়াসহ সব ধরণের সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। কৌতুহলী আলম হাজির হয় সেই বাড়িতে। জ্বীন নামানোর পর্বটি আবার দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত। তবে শর্ত হচ্ছে পাক-পবিত্র পোশাক পরে এবং ওজু করে আসরে বসতে হবে। সব নিয়ম মেনেই আলম দুরু দুরু বুকে অন্ধকার ঘরে বসে থাকে। সেখানেই কোব্বালার সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাত। এর পর থেকেই জ্বীন কোব্বালা তার সঙ্গে আছে।
হাইওয়ে ধরে সাঁই সাঁই করে বাস যাচ্ছে-আসছে। চারদিতে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ। বাস স্ট্যান্ডে হাজারো মানুষের আনা-গোনা। এই পরিবেশে এ ধরণের একটি আষাড়ে ভুতের গল্প! হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না তন্ময়। চা দোকানী আলমের মানষিক সুস্থ্যতা নিয়ে এবার সন্দেহ জাগে। আর মনে মনে নিজেতে গাল দেয়, এই ছেদো গপ্প শুনে সময় নষ্ট করার জন্য।
তন্ময়ের মনের অবস্থা আঁচ করতে পারে আলম।
'আপনের পকেটের মানিব্যাগটা যে আপনেরে দিছে হ্যায় আপেনেরে ছাইরা চইলা গেছে। অনেক দূরে।'
ফ্যাল ফ্যাল করে আলমের দিকে তাকিয়ে থাকে তন্ময়। বিচিত্র অনুভুতি খেলা করতে থাকে তার ভেতর। তন্ময়কে ছেড়ে শ্বেতা ডিভি লটারি পওয়া এক যুবকের হাত ধরে হাসতে হাসতে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু এ কথা এই চায়ের দোকানদান আলমের কিছুতেই জানার কথা না। আস্তে আস্তে তন্ময়ের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তীব্র চোখে আলম আলম তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
'আমারে বিশ্বাস না করতে পারেন, কিন্তুক কোব্বালারে বিশ্বাস না করনের কুনু পথ নাই।'
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলম বলতে শুরু করে, 'পরথম পরথম খুব যন্ত্রণা দিছে। ঘাড় বাইয়া মাথায় উইঠা যাইতো। হের পরে আমার হইতো বুদ্ধি নাশ। কী কী কাম যে করতাম, নিজেই কইতে পারতাম না। একবারতো দাও দিয়া কোপাইয়া এক ল্যাংড়া ফকিররে মাইরাই ফালাইলাম। তয় কেউ দেখনের আগেও সইরা পরছিলাম বইলা থানা-পুলিশের ঝামেলায় পড়িনাই। হের পরেও কোব্বালা আমারে দিয়ে আরো কতগুলান খুন করাইছে। তয় হেয় খুব চালাক, আমারে ধরা খাওয়ায় নাই।
একবারতো গেরামের লুকজন মিলা আমার ধইরা-বাইন্দা পাবনা মেন্টাল হসপিটালে পাডাইলো। কিন্তুক হেইখানে আমার ওয়ার্ডের দুইজন নার্স আর একটা আয়া খুন হওনের পর হাসপাতাল থিকা আমার বাইর কইরা দিছে।'
মোহাবিষ্টের মতো আলমের বিচিত্র কাহিনী শুনে যায় তন্ময়।
'তয় দিনে দিনে আমিও কোব্বালারে বশ করন শিখছি। অখন আর মাথাত চড়তে দেই না। সব সময় কমরের নীচে রাখনের চেষ্টা করি। তয় রাইতে হের উপর আমার কন্টোল থাকেনা। হের লেইগা রাইতে নিজের ঘরেই বাইরে দিয়া তালা মাইরা শুই।'
তন্ময় বুঝতে পারে না আলমের কথাগুলো কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য। আর কেনই বা তাকে এসব গল্প শোনাচ্ছে!
'কোব্বালার মতো খবিস জ্বীনের পাল্লায় যদি পরেন, তাইলে মনে রাখবেন, কুনু সময় হেরে মাথাত উঠতে দিবেন না। বসে রাখবেন। একবার যুদি মাথাত উঠে, তাইলে হেয় আপনের বুদ্ধিরে বশে নিবো। তখন হেয় আপনেরে দিয়া যা খুশি তা করাইতে পারবো। কোব্বালার মুশ্কিল কী জানেন, হেয় বেশি দিন একজনরে ভর কইরা থাকতে পারে না। যখনই হেই মানুষটা তারে বশ করন শিখা যায়, কথনই কোব্বালা নতুন আশ্রয় খুজতে থাকে। অখন আর কোব্বালা আমারে না, আমিই কোব্বালারে চালাই। এখন কোব্বালা নতুন কাউকে খুঁজছে'
এটুকু বলে থামে আলম। দু চোখ তুলে সরাসরি তাকায় তন্ময়ের দিকে। তার চোখদুটো যেন তার কপাল ভেদ করে সরাসরি মস্তিষ্ক দেখতে পাচ্ছে। তন্ময়ের মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত নেমে যায়। ভেতর থেকে কে যেন ক্রমাগত তাড়া দিতে থাকে-পালাও পালও। ছিটকে দোকান থেকে বেড়িয়ে আসে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্যভাবে সামনে যে বাসটি পায় ঝড়ের বেগে চড়ে বসে তাতে। একটু পরই লক্ষ্য করে এটি ঢাকাগামী নয়, ময়মনসিংহের দিকে চলছে। যাই হোক পরে বাস বদলে নেওয়া যাবে। ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে।
ধাতস্ত হয়ে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ভাবতে থাকে তন্ময়। এবার নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগে। দিনে দুপুরে এমন একটি উদ্ভট ভুতের গল্প শুনে ভয়ে দৌড়ে পালালো সে! যাই হোক বাস পাল্টে ঢাকামুখী একটি সরাসরি বাসের সিটে বসে মথা এলিয়ে দেয়।
সারাদিন খুব ধকল গেল। চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল হয়তো। হঠাৎ ঘাড়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করে তন্ময়। দু চোখে আঁধার নেমে আসে। অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে হলদেটে ক্রুর দুটি চোখ দেখতে পায়। একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে। ওই চোখদুটি যেন তন্ময়ের চোখের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। মাথার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায় হঠাৎ। তীব্র একটি জান্তব বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠে। তন্ময় বুঝতে পারে কোব্বালা নতুন আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে।
রিমি

একটা দু:স্বপ্ন দখে ঘুম ভেঙ্গে যায় রিমির। বুকটা ধ্বক ধ্বক করতে থাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইল ফোনটা খুঁজে নিয়ে বোতাম টিপে সময় দেখে।
ভোর ৪টা ২২ মিনিট।
ঠিক এসময় চারদিক থেকে ভেসে আসে ফজরের আজানের ধ্বনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একের পর এক মসজিদ থেকে ভেসে আসা আজান শুনতে শুনতে একটু আগে দেখা স্বপ্নটা মনে করার চেষ্টা করে রিমি।
কিন্তু কী আশ্চর্য! কিছুই মনে পড়ছে না।
অথচ, সেই দু:স্বপ্নের রেশ এখনও আছে। গায়ের সবগুলো লোম খাড়া হয়ে আছে। বুকের ভেতর এখনও উলট পালট হচ্ছে।
দাদী বলতেন, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। কথাটি মনে পড়ে আবারও নতুন করে আতঙ্ক জাগে রিমির ভেতর। অজানা আশঙ্কায় বুকটা কাঁপতে থাকে।
বান্ধবীদের কাছে শুনেছে বিয়ের আগে নাকি মেয়েদের মনে অনেক রকম অজানা ভয়-আতঙ্ক তৈরি হয়। হয়তো নতুন পরিবেশে, নতুন একজন মানুষের সঙ্গে জীবন যাপনের অনিশ্চয়তা থেকেই এই আতঙ্কের সৃষ্টি। কিন্তু যার সঙ্গে রিমির বিয়ে হচ্ছে সে তো তার কাছে নতুন কেউ নয়। সেই কৈশরে যখন নিজের ভেতর রহস্যময় পরিবর্তনগুলো টের পাচ্ছিলো, তখন থেকেই এই মানুষটিকে মনে প্রাণে চাইছে সে। প্রথমে এই ভালোলাগাটি ছিল নিছক মুগ্ধতা মাখানো বিষ্ময়। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, এই মানুষটির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার নিয়তি। তাকে ছাড়া এক মুহুর্তও জীবন যাপন সম্ভব নয়। অনেক চড়াই উতরাই পেড়িয়ে যখন তাকে কাছে পাওয়ার মুহুর্তটি একেবারে এগিয়ে এসেছে, তখন এই সদ্য দেখা অথচ বিস্মৃত ভয়ঙ্কর স্বপ্নটি বুকের ভেতর একটা অজানা আশঙ্কা তৈরি করছে।
মশারির ভেতর থেকেই জানালার পরদা সরিয়ে বাইরে তাকায় রিমি।
চারদিক এখনও আবছা অন্ধকারে ঢাকা।
ঘুম যখন ভেঙ্গেছেই তখন আর শুয়ে থেকে কী লাভ!
বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই তীব্র বোটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠে। পেট চেপে মেঝেতে বসে হড়হড় করে বমি করে দেয় রিমি। অশুভ এক আতঙ্কে সারা শরীর কাঁপতে থাকে। মনে হয় পৃথিবীর কোথাও চরম কোনো অঘটন ঘটছে। অদ্ভুত এক অজানা ভয়ে রীমির পুরো শরীর বরফের মতো জমে যায়। এই মুহুর্তেই বাথরুমের দরজা খুলে দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার একটা তীব্র তাগিদ অনুভব করে। কিন্তু মেঝের সঙ্গে কেউ যেন তার পা আটকে রেখেছে।
দীর্ঘ কয়েক মুহুর্ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছিটকিনি খুলে বের হয়। ততোক্ষণে ঘেমে গোসল হয়ে গেছে। গয়ের নাইটিটা ভিজে সপ্সপ্ করছে। যেন কেউ একবালতি পানি ঢেলে দিয়েছে গায়ে।
রুমে ঢুকেও সেই অস্বস্তিকর বাজে গন্ধটার অস্তিত্ব টের পায় রিমি। এখানে বরং দুর্গন্ধটির তীব্রতা আরো বেশি।
বিছানার ভেতর আলো জ্বেলে নি:শব্দে বাজতে থাকে মুঠোফোন। নিরবিচ্ছন্ন ঘুম নিশ্চিত করতে রাতে রিংগার অফ করে বিছানায় যায় রিমি।
এক ধরণের বোবা আতঙ্ক নিয়ে মোবাইল ফোনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে হয়, এই ফোন কলটি অন্য কোনো জগতের এক অশুভ বার্তা নিয়ে এসেছে। বাজতে বাজতে একসময় থেমে যায়। আবারও রিং আসে।
কাঁপা হাতে ফোনটি তুলে নেয় রিমি। স্ক্রিনে তন্ময়ের নাম দেখে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। নিজের বোকামিতে নিজে নিজেই হেসে উঠে। যার একটি কলের জন্য সকাল-সন্ধ্যা প্রতি মুহুর্ত অপেক্ষায় থাকে, তার ফোন পেয়েই এতো ভয়। কিন্তু এতো সকালে সে কী করছে। অন্য সময়তো ছুটির দিনে বাবুর ঘুম ভাঙ্গে ভোর দশটায়।
সবুজ বোতাম টিপে হ্যালো বলে রিমি।
অপর প্রান্ত থেকে কেমন যেন ফ্যাস ফ্যাসে কণ্ঠ ভেসে আসে
- কী করছিলে রিমি?
- এই মাত্র ঘুম ভাঙ্গলো, বাথরুমে ছিলাম।
- ফোন ধরতে এতো দেরি হলো কেন? ভয় পেয়েছিলে?
এ প্রশ্নে চমকে উঠে রিমি। ভয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? সে যে ভয় পেয়েছে তন্ময়ের তো সেটা জানার কথা নয়! যাই হোক, এসব নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করে রিমি
- তুমি এতো সকালে কী করছো? আর তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন? শরীর ঠিক আছে তো?
খল খল করে অচেনা শব্দে হেসে উঠে তন্ময়। যার ভরাট গলার হাসি শুনে এখনও মুগ্ধ হয়ে যায় রিমি, তার হাসির শব্দেই আজ গা শিউরে উঠে।
- না, আমার কিছু হয়নি, আমি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। রাতে অনেক কাজ ছিল। এখন ঘুমুতে যাচ্ছি।
এ কথা বলে কোনো রকম বিদায় না জানিয়েই আচমকা লাইন কেটে দেয় তন্ময়। ছোট্ট ফোনটি হাতে নিয়ে স্থানুর মতো বসে থাকে রিমি। বাইরে তখন একটু একটু করে আলো ফুটছে। চারদিকে পাখির কিচির মিচির ডাকে কান পাতা দায়।

চারদিক আলো করে সূর্য উঠেছে আজ। ছুটির দিন। বাইরের ঘরে বসে রং মিস্ত্রিদের নির্দেশ দিচ্ছেন রিমির বাবা মোর্শেদ আলম। দুদিন পর মেয়ের বিয়ে। বাড়িতে একটু রং না করালে চলে না।
চায়ের পেয়ালা হাতে বাবার কাছে এসে দাঁড়ায় রিমি। চারদিকে কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব। তার জন্যই এতো আয়োজন। ভাবতে গিয়ে একটু লজ্জা হয়, ভালো লাগে তার চেয়েও অনেক বেশি।
ছোটভাই বাবু তার কতোগুলো চ্যাংড়া বন্ধুবান্ধব নিয়ে দোতলার রুমে জটলা করছে। দফায় দফায় চা যাচ্ছে সেখানে। তার বন্ধুরাই নাকি হলুদের স্টেজ, আলপনা এসব কিছু করবে। মা ব্যস্ত রান্নাঘরে। একজন বাঁধা কাজের মানুষ আর ছুটা বুয়াকে নিয়ে রান্নাঘরে গলদঘর্ম হচ্ছেন। ধানমন্ডি থেকে ছোট খালা আসবেন আসবেন। বিকেলে সবাই মিলে মার্কেটে যাবে বিয়ের কেনাকাটা করতে।

বাড়িতে সবাই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। শুধু কাজ নেই রিমির হাতে। পুরো বাড়িটায় একটা চক্কর দিয়ে নিজের ঘরে এসে বসে। রাতের ঘটনাটি ভেবে এখন নিজেরই হাসি পাচ্ছে। আশপাশে কোথাও হয়তো কিছু পঁচেছে, সেই গন্ধেই আতঙ্ক অস্থির হয়ে পড়েছিল সে। আর বমিতো হয়েছে অ্যাসিডিটি থেকে। এই সমস্যাটিতো নতুন কিছু নয়। একটা এন্টাসিড প্লাস খেয়েই হাতে হাতে ফল পেয়েছে।
তন্ময়কে নিয়ে একটু চিন্তিত রিমি। ফোনে কেমন উল্টাপাল্টা কথা বলছিলো। কাল রাতেও নিশ্চই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে ছাইপাশ গিলেছে। অকেশনালি একটু আধটু ড্রিংক করলে ঠিক আছে। সে ক্ষেত্রে কিছু মনে করবে না রিমি। এতোটা পিউরিটান নয় সে। কিন্তু এটা অভ্যাসে পরিণত হলেই তার আপত্তি। দাঁড়াও বিয়ের পর সব ঠিকঠাক করে দেবো। তখন দেখা যাবে কার কতো মুরোদ। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মোবাইল ফোনের বোতাম টেপে। টানা সাতটি রিং হওয়ার পর তন্ময়ের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ শোনা যায়।
- হ্যালো, এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠো। বাথরুমে গিয়ে কিটন হয়ে এসে দশ মিনিটের মধ্যে আমাকো ফোন করো।
একটানা নির্দেশের সুরে কথাগুলো বলে ফোন রেখে দেয় রিমি। একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে। যানে, ঠিক দশ মিনিটের মাথায় কলব্যাক করবে তন্ময়। সারাটা জীবন এভাবেই মানুষটিকে আদরে-শাসনে বেঁধে রাখবে রিমি। হে পরম করুনাময়, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত আনন্দ-ভালোবাসায় পূর্ণ করে দাও। চোখ থেকে দু ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। চমকে উঠে চোখ মোছে রিমি।
আজ তার হলোটা কী! অকারণ ভয়, অকারণ আবেগ- নিজের কাছেই কেমন যেন লজ্জা পায়।
আসলে পুরো ব্যপারটাই স্বপ্নের মতো লাগে।
তখন মাত্র কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে রিমি। তন্ময়ের প্রেমে তখন সারা পৃথিবী তার আচ্ছন্ন। আশপাশে আর কোনো কিছুই নজরে পড়ে না। নয়তো সে ঠিকই বুঝতে পারতো ইউনিভার্সিটির বান্ধবি শ্বেতার সঙ্গে তন্ময়ের হৃদয়ের বোঝাপড়া চলছে। বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর যখন রিমি বুঝতে পারে, ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রিমি তখন ইউনিভার্সিটিতে মাত্র ভর্তি হয়েছে। টিএসসি, বই মেলা বা রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনের মাঠে তাদেও দুজনকে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যেতো। কিন্তু তন্ময়ের অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা রিমির কখনোই বিশ্বাস হয়নি। তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে যখন তাদেও দুজনের এনগেজমেন্টের দিন ঠিক হয়ে যায়।
সে সময় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল রিমি। ঠিক তখনই তন্ময়কে ছেড়ে আমেরিকা পাড়ি জমায় শ্বেতা। সেই দু:সময়ে তন্ময়ের পাশে এসে দাঁড়ায় রিমি। অফুরন্ত ভালোবাসা আর মায়ায় সারিয়ে তোলে তন্ময়ের হৃদয়ের ক্ষত। এতো কিছুর পর আজ সেই ক্ষণ উপস্থিত। দুদিন বাদেই বিয়ে। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় কাঁপছে রিমি। সকালে তন্ময়ের সঙ্গে ফোনে কথা হওয়ার পর সকল অস্বস্থি এক লহমায় উড়ে গেছে। ভোরবেলার ভয়ের কোনো স্মৃতিই এখন আর তার ভেতর নেই।

দুপুরে খাওয়ার পর জম্পেস আড্ডা আর কয়েক দফা চা খেয়ে সবাই উঠে পড়ে মার্কেটে যাওয়ার জন্য। আরামদায়ক এক ধরণের আলস্য নিয়ে বিছানায় গড়ায় রিমি। খালি বাড়িটা কেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। শীর্ষেন্দুর একটা জমজমাট উপন্যাসের পাতা উল্টাতে উল্টাতে এক সময় ঘুমে ঢলে পড়ে।

তীব্র বোটকা এক ধরণের পচা গন্ধে ঘুম ভাঙ্গে রিমির। প্রথমে বুঝতেই পারে না, এখন দিন, নাকি রাত। মুহুর্তেই সব কিছু মনে পড়ে যায়। সন্ধ্যা পেরিয়ে কখন চারদিক আঁধার হয়ে এসছে। বাবা-মা এখনো মার্কেট থেকে ফিরেনি। ভোরবেলার আতঙ্কটা এবার শতগুণ বেড়ে সাড়াসির মতো চেপে ধরে রিমির পুরো অস্বিত্বকে। সারা শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। নাড়ি উল্টে বমি আসে। বাথরুম পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ হয়না এবার, ঘরের মেঝে ভাসিয়ে দিয়ে দুপুরের খাবার পুরোটাই পেট থেকে উগড়ে দেয়। আগস্ট মাসের গরেমেও ঘরের ভেতরটা কেমর অদ্ভুত শীতল হয়ে আসে। আর আশ্চর্য, এর মধ্যেও কুল কুল করে ঘামতে থাকে রিমি।

অনেক দিন আগে কোব্বালা গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি পড়ে অনেকেই বলেছিলেন, এটা আরো বড় হতে পারতো। আমিও তাদের সঙ্গে একমত। কিন্তু আলসেমি করে আর লিখা হয়ে উঠেনি। গত রাতে গল্পটি শেষ করেছি। শেষ করে দেখলাম ব্লগে প্রকাশের জন্য এটা অনেক বড় হয়ে গেছে। তাই কয়েক ভাগে দেবো বলে স্থির করেছি। অবশ্য যদি ব্লগার বন্ধুদের ভালো লাগে তবেই। পড়ে জানাবেন কেমন লাগছে। ভালো না লাগলে এখানেই শেষ করে দেবো। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম। ধন্যবাদ। 



আবুল খায়ের

খুব বড় ধরণের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অসুস্থ্যতা না থাকলে প্রতি ওয়াক্তের নামাজ মসজিদে গিয়েই পড়ার চেষ্টা করেন খায়ের সাহেব। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস।
আস সালাতুল খাইরুল মিনাননাউম.. .. .. ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম- মুয়াজ্জিনের এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আলস্য ঝেড়ে বিছানায় উঠে বসেন। পা বাড়ান মসজিদের দিকে।
কাল রাত থেকেই আকাশে মেঘ, সকালেও এর রেশ রয়ে গেছে।
সদর দরজা খুলে রাস্তায় পা দিতেই একটা দৃশ্য নজর কেড়ে নেয়। বিভৎস এই দৃশ্য থেকে চোখ ফেরানো মুশ্কিল আবার এর দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকাও সম্ভব নয়। বাড়ির গেটের সামনেই একটি মৃত কুকুর পড়ে আছে। কুকুরটির পেছনের অর্ধেকটা উধাও, মনে হয় কেউ যেন খুবলে খেয়ে নিয়েছে কুকুরের পেছনের দুটো পাসহ অর্ধেকটা। পেটের কাছ থেকে সামনের দুটো পা আর মাথাটা নিয়ে নিথর পড়ে আছে কুকুরটি। নারিভুরি ছড়িয়ে আছে রাস্তায়। পুরো রাস্তা রক্তে মাখামাখি।
দৃশ্যটির মধ্যে এমন এক অমানুষিক ব্যপার রয়েছে যা খায়ের সাহেবের পুরো অস্তিত্বকে কাঁপিয়ে দেয়। ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ বলে রাস্তায় বসে পড়েন তিনি। একটু ধাতস্ত হয়ে টলতে টলতে ঘড়ে ঢুকে ধপ করে সোফায় বসে ঘামতে থাকেন।
ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে আসে চারপাশ। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা বাড়ে। শহুরে কোলাহলে থেমে যায় পাখিদের কলরব। তার পরেও স্থাণুর মতো বসে থাকেন আবুল খায়ের। মনের ভেতরটা কু গাইছে।
সারা দিনই শরীরটা ভালো যায় না খায়ের সাহেবের। দুপুর বেলা খেতে বসে একটু ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়েন।
‘আপনি কী কোনো কিছু নিয়া চিন্তা করতেছেন?’
‘না না, এই শরীলটা ঠিক জুত লাগতাছে না।’ স্ত্রীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে কেন যেন একটু বিব্রত বোধ করেন তিনি।
তন্ময় কই? খাইবো না?’
‘হে তো দরজা বন্ধ কইরা নিজের রুমে ঘুমাইতাছে। কাইল সারা রাইত ঘুমায়নাই। নিজের ঘরে বইসা কিজানি কি খটর মটর করছে।’
স্ত্রীর এই উত্তর শুনে কেন যেন পুরোনো অস্বস্তিটা আবার ফিরে আসে। গত কয়েক দিনের মধ্যে ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিনা মনে করার চেষ্টা করেন। কি আশ্চর্য, শেষ কবে তন্ময়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে তা কিছুতেই মনে করতে পারেন না আবুল খায়ের।
এ চিন্তা নিয়েই খাবার টেবিল থেকে উঠে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েন তিনি। নিজের অজান্তেই এক সময় ঘুমে ঢলে পড়েন; যদিও দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাস তার কোনো কালেই ছিলো না। ঘুম ভাঙ্গে মাগরেবের ওয়াক্তে।
দীর্ঘ দিন পর আসরের নামাজ কাজা হয়ে যায়। (ক্রমশ)


ড. হায়দার মবিন

মবিন সাহেব অতি সজ্জন ব্যক্তি। নিখুঁত ভদ্রলোক। গল্প-উপন্যাসের অ্যাবসেন্ড মাইন্ডেড প্রফেসরদের মতো উদ্ভট পোশাক পড়া কিংবা উল্টাপাল্টা হাস্যকর কান্ডকারখানাও করে বেড়ান না তিনি। কিন্তু পাড়ার লোকজন তাকে একটু সন্দেহের চোখেই দেখে। কারণ আর কিছুই না, তার গবেষণার বিষয়বন্তু। সারা দুনিয়ার মেধাবীরা যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করছে, তখন ড. হায়দার মবিন গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রেততত্ত্ব।

যুক্তরাষ্ট্রেও ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়তে গিয়ে সাত বছর মার্কিন মুল্লুকে কাটিয়ে আসেন তিনি। এ সমটির বেশিরভাগই তিনি ব্যয় করেছেন প্রেততত্ত্বর গবেষণায়। ইউনিভার্সিটির ডর্মের রুমমেট জেসনের পাল্লায় পড়ে প্রথম এ বিষয়ে আগ্রহ জন্মায়। জেসন ছিল প্রেস সাধকদের একটি চক্রের সদস্য। হায়দার মবিন অবশ্য জেনসের পথে হাঁটেননি। প্রেত বা অশুভ আত্মার স্বরূপ সন্ধানে গবেণা করেছেন তিনি। কিভাবে এসব অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করা যায় সে বিষয়টিই ছিল তার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

অশুভ শক্তি নিয়ে গবেষণার জন্য কোথায় কোথায় না গিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের তাবৎ শহর থেকে শুরু করে পাহাড়-পর্বত, বন-জঙ্গল কিছুই বাদ রাখেন নি। অবশ্য যে বিষয়ে পড়তে গিয়েছিলেন তাতেও একটা ডিগ্রি নিয়ে ফিরেছিলেন। ভাগ্যিস এ কাজটা করেছিলেন, নয়তো দেশে ফিরে গ্রাসাচ্ছাদনই মুশ্কিল কয়ে পড়তো। এখানেতো আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ভুততত্ব’ পড়ানো হয় না। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র পড়ান। সেটা নিছক পেট চালানোর জন্য। নেশা বলতে ওই অতীন্দ্রীয় বিষয় নিয়ে গবেষণা। অকৃতদার মবিন সাহেবের কাজে বাধা দেওয়ার মতোও কেউ নেই। তাই মহানন্দে পুরো সময়টাই তিনি প্রেত বিষয়ে চর্চা করে কাটান।

দীর্ঘ বার বছরের পারবাস্তব বিষয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতায় এই প্রথম হোঁচট খেয়েছেন হায়দার মবিন।
গত কয়েক দিন ধরে যতোবারই ধ্যানে বসে মনোসংযোগের চেষ্টা করেছেন, ততোবারই একটি চরম অস্বস্তিকর অনুভুতি তার একাগ্রতায় বাগড়া দিয়েছে। যেন একটা তাগিদ তাকে তাড়া করে ফিরছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসেতে এক সাধু বলেছিলেন, সাধনার একটি স্তরে পৌছালে অনেক দূর থেকেই অশুভ কোনো কিছুর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়।
তাহলে কী হায়দার মবিন সেই স্তরে পৌছে গেছেন?

‘স্যার, আসতে পারি?’
কপাল কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করেন। ও হ্যা মনে পড়েছে; এমবিএ থার্ড সেমিস্টারের ছাত্রী। মেয়েটির হাতে একটা কার্ড। তার লাজুক হাসি দেখে মনে হচ্ছে এটি সম্ভবত তার বিয়ের কার্ড। কিন্তু আজকালতো মেয়েরা পড়া শেষ না করে বিয়েই করতে চায় না।
‘রিমি, কি ব্যপার বলো তো? তোমার বিয়ে নাকি?’
এ প্রশ্নে লজ্জাল লাল হয়ে যায় রিমি। এগিয়ে এসে কার্ডটি হায়দার মবিনের হাতে তুলে দেয়। তার আঙ্গুল মবিন সাহেবের আঙ্গুল স্পর্শ করে। বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চমকে উঠেন মবিন। তার গা থর থর করে কাঁপতে থাকে। হিস্টিরিয়া গ্রস্তের মতো কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়েন তিনি। আকষ্মিক এ ঘটনায় হতচকিত হয়ে যায় রিমি।
‘স্যার, স্যার আপনি ঠিক আছেন?’
কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ারে বসেন হায়দার মবিন।
লম্বা নিশ্বাস নিয়ে আরেকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকান তিনি। অশুভ আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অশুভ শক্তি নিয়ে গবেষণার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকেও যথেষ্ট মনে হয়না মবিনের। নিজেকে দারুন অসহায় মনে হয়। এ মেয়েটির উপর যে অশুভ শক্তির ছায়া পড়েছে, কিভাবে এর মোকাবেলা করবেন তিনি? এতো শক্তি কী তার আছে?

কিন্তু যুগে যুগে শুভ শক্তির কাছে অশুভ আত্মার যে পরাজয়ের ইতিহাস, হায়দার মবিন সে পরম্পরাকে নষ্ট হতে দিতে পারেন না। ঘটনাচক্রে এই গুরু দায়িত্ব এখন হায়দার মবিনের কাঁধে এসে পড়েছে। পিছিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। ইচ্ছায় হোক, আর অনিচ্ছায় হোক এই শক্তির মোকাবেলা তাকে করতেই হবে।

কাঁপা হাতে টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক নিশ্বাসে শেষ করেন হায়দার মবিন। রিমির কাছ থেকে চেয়ে তার বাড়ির ঠিকানাটি লিখে নেন। আরেকটু পড়াশোনা করতে হবে, আরেকটু জানতে হবে। হোমওয়ার্ক করে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে তবেই এই শক্তিশালী প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হবেন হায়দার মবিন।

কদিন ধরে নাওয়া-খাওয়া ভুলে বইপত্র ঘাটছেন মবিন সাহেব। আর নিয়মিত ধ্যানে বসছেন। মনের একাগ্রতা খুবই জরুরি। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানষিক শক্তিই হচ্ছে প্রধান অস্ত্র। সেদিনও বিকেলে লাইব্রেরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় নিজের ভেতর একটা তীব্র তাগিদ টের পান। ভুতগ্রস্তের মতো ছুটে গিয়ে গাড়ির চাবিটা তুলে নিয়েই বেরিয়ে পড়েন। গাড়িটারও যেন প্রাণ আছে। স্টিয়ারিং হুইলটা নিজেই তাকে কোনো একটা লক্ষ্যে টেনে নিয়ে যাচ্চে। নিয়তির হাতে নিজেকে সপে দিয়ে কাঠ হয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকেন। ঢাকার ব্যস্ত ট্রাফিক উপেক্ষা করে আশি মাইল গতিতে ছুটতে থাকে তার সাদা টয়োটা।

সময় নেই, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই পৌছাতে হবে। মাথার ভেতর কে যেন ক্রমাগত ফিস ফিস করে কথাগুলো আউড়ে যায়। রিমির দেওয়া ঠিকানাটা বাড়িতেই পড়ে থাকে। হায়দার মবিন বুঝতে পারেন, সেটির আর কোনো দরকার নেই। প্রয়োজনই তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেবে।


এবং কোব্বালা

রিমির রুমের দরজা ভেজানো।
সন্ধ্যা হয়ে এলো। ঘরের বাতি জ্বালেনি রিমি। আসলে বাতি জ্বালানোর মতো এক ফোটা শক্তি তার শরীরে অবশিষ্ট নেই। কোনো এক অদৃশ্য শক্তি রিমির ভেতরের প্রাণ শক্তির শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিয়েছে। তাই নিথর হয়ে বিছানায় পড়ে আছে রিমি।

বাড়িতে কেউ না থাকলেও ভেতরে ঢুকতে তন্ময়ের কোনো সমস্যাই হয়নি। এখানে সে অনাহুত নয়, বরং রীতিমতো ভিআইপি। কদিন পরই ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রিমিকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। তাই তন্ময়ের ভেতরে ঢোকার ব্যপারা কাজের লোকেরা কোনো আপত্তিই করেনি।

ধীরে ধীরে রিমির বিছানার দিকে এগিয়ে যায় তন্ময়। ভাবলেশহীন চোখে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে রিমি। হাতের একটা আঙ্গুল নাড়ানোর মতো শক্তিও তার নেই। তার নিয়তির মতো এগিয়ে আসতে থাকে তন্ময়...না না তন্ময়ে ভর করে অন্য কিছু, যার চোখে হিংস্র পশুর নিষ্ঠুরতা। মুখের দু পাশের চোয়ালের হাড় ঠেলে উচু হয়ে আছে। এই তন্ময়কেতো রিমি চেনে না। এ কে! গলা দিয়ে একটু শব্দও বের করতে পারেনা রিমি। দুটো আদৃশ্য হাত যেন তার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে। একটা যান্তব বোটকা গন্ধে পুরো কামড়ার বাতাস ভারি হয়ে আসে।

অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে তন্ময়, না তন্ময় নয়, তার ভেতরের অশুভ স্বত্ত্বাটি,

‘রিমি, তুমি হবে এ পৃথিবীর প্রথম সৌভাগ্যবান নারী। কোব্বালার বংশধর আসবে তোমার ঔরষে। তুমি হবে এ পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর শক্তির জন্মদাত্রী। সারা পৃথিবীর শয়তানের উপাসকরা তোমাকে পূজা করবে।’

তন্ময়ের প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে ভেসে আসে গা গুলানো দুর্গন্ধ। দু ঠোট ঠেলে বেরিয়ে থাকা জিব বেয়ে নেমে আসছে চটচটে অস্বস্তিকরা আঠালো পদার্থ। দু হ তের নখের ভেতর জমাট বেধে আছে কালচে ময়লা।

রিমির চোখের সামনে একটি ভারি কালো পর্দা নেমে আসে।

তন্ময় যখন ধীরে ধীরে রিমির উপর ঝুঁকে আসছে, তখনই বিদ্যুত গতিতে সেখানে প্রবেশ করেন হায়দার মবিন। প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় তন্ময়। শ্বাপদের হলদে দৃষ্টি নিয়ে মবিনের চোখে চোখ রাখে। রাগ আর ঘৃণায় মুখের চামড়া কুঁচকে আসে। জিবটাকে এক বিঘা পরিমাণ বের করে মুখের চারপাশটা চেটে নেয়। দৃশ্যটি দেখে ঘৃণায় সারা শরীর রি রি করে উঠে হায়দার মবিনের। চাপা হুঙ্কার ছেড়ে এক পা এক পা করে মবিনের দিকে এগুতে থাকে তন্ময়। তার চোখে চোখ রেখে নিজেরে জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন হায়দার মবিন। ঠিক এক হাত সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে দুজন। সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে যায়। তন্ময়ের শরীরের আশ্রয় ছেড়ে কোব্বালার অস্তিত্ব গ্রাস করে নিতে চায় হায়দার মবিনকে। মুহুর্তের ভগ্নাংশের অন্যমনষ্কতা, কিংবা চুল পরিমাণ সুযোগ খুঁজতে থাকে অন্য ভূবণ থেকে আসা এই অনাহুত শক্তি। তীব্র মানষিক শক্তি আর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে হায়দার মাবিন বুঝতে পারেন, কোব্বালাকে কোনো সুযোগ দেওয়া যাবে না। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করতে থাকেন তিনি। আর সতর্ক সাবধানতায় সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেন কোব্বালার রণকৌশল। স্নায়ুর লড়াই চলে শুভ আর অশুভের। হায়দার মবিনের সারা শরীর দিয়ে ফোয়ারার মতো ঘাম ঝড়তে থাকে। টকটকে লাল মুখমন্ডল দেখে মনে হয় শরীরের সব রক্ত এসে মুখে জমা হয়েছে। তন্ময়ের চোখে উঁকি দেওয়া কোব্বালার সঙ্গে মরণপণ লড়াই চালিয়ে যান। শরীরের প্রতিটি কোষ বিদ্রোহ শুরু করে। খুলি ফেটে যেন মস্তিষ্ক বেড়িয়ে আসবে।

এভাবে কতোক্ষণ কেটেছে জানা নেই। সহ্যের শেষ সীমায় পৌছে পরাজয়ের কাছে আত্মসমর্পণের মুহুর্তে হায়দার মবিন অনুভব করেন, কোব্বালা পিছু হটছে। আসন্ন বিজয়ের আশায় একটু হয়তো অসতর্ক হয়েছিলেন, মুহুর্তের জন্য হয়তো একবার চোখের পলক পড়েছিলো, এ সুযোগে হায়দার মবিনের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তন্ময়। হিংস্র শ্বাপদের মতো তীক্ষ্ণ দাঁত দিয়ে টুটি কামড়ে ধরতে চায়। হায়দার মবিনের গলায় ঝুলানো প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান সাধকের আঙ্গুলের হাড় দিয়ে তৈরি মালাটির সংস্পর্শে আসামাত্রই বিকট জোরে জান্তব চিৎকার দিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে তন্ময়। অমানুষিক এই চিৎকারে হায়দার মবিন দুচোখে অন্ধকার দেখেন। কিন্তু মুহুর্তের জন্যও কর্তব্যবোধ থেকে বিচ্যুত হননা। অশুভশক্তির দুর্বলতার সুযোগে নিজের গলা থেকে হাড়ের মালাটা বের করে পরিয়ে দেন তন্ময়ের গলায়। হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো কাঁপতে কাঁপতে একসময় স্থির হয়ে যায় তন্ময়। তার চোখ থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে অমানুষিক অশুভ ছায়া। একটু একটু করে মনুষত্ব উঁকি দেয়। এক সময় দুচোখ বুজে নিস্তেজ হয়ে ঢলে পড়ে।

তন্ময়ের গলায় ঝোলানো মালাটির দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন হায়দার মবিন। নিউইয়র্কে এক ম্যাক্সিকান বুড়ির গ্যারেজ সেল থেকে এটি কিনেছিলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বুড়ি এ মালাটির বিশেষ আধ্যাতিক গুনাগুনের বর্ননা করেছিলো। বুড়ির কথাগুলো তখন এতোটুকু বিশ্বাস করেননি মবিন। মালাটির রহস্যময় সৌন্দর্য টেনেছিলো। হাতে নিতেই এক ধরণের বিচিত্র অনুভুতি হয়েছিলো। সেজন্যই এটা কিনে নেন। আর তখন থেকেই এটা মবিনের গলায় শোভা পাচ্ছে। কিন্তু আজকে এই চরম বিপদেও মুহুর্তে ম্যাক্সিকান বুড়ির সেই কথাগুলো এভাবে জ্বলজ্বলে সত্যি হয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।

বিছানায় ধীরে ধীরে উঠে বসে রিমি। মেঝেতে পড়ে থাকা তন্ময়কে দেখে একটু আগের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে হায়দার মবিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে থাকে। তার মাথায় পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দিয়ে মবিন বলেন,

‘চিন্তার কিছু নেই রিমি, সব ঠিক হয়ে যাবে। তন্ময় আবার আগের মতো হয়ে উঠবে। শুধু লক্ষ্য রাখবে আগামী সাত দিন যেন সে ঘর থেকে না বের হয়। এ সময় যেন সে এক মুহুর্তেও জন্যও একা না থাকে। আমি প্রতিদিনই সকাল-বিকেল এসে তন্ময়কে কাউন্সেলিং করে যাবো।

মেঝেতে পড়ে থাকা তন্ময়ের রুক্ষ চুলগুলোতে এবার পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয় রিমি। মনে মনে হাসেন গোলাম হায়দার। তন্ময় অবশ্যই ভালো হয়ে উঠবে। ভালোবাসার চেয়ে বড় শক্তি আর কী আছে। (শেষ) 

0 comments:

Post a Comment

    Definition List

    Text Widget